এ কি সহজ কথা! ইরানে অত্ত বড়, অত্ত ভয়ানক একটা ভূমিকম্প হয়ে গেল, কত লোক বেঘোরে মরে গেল শুধুমাত্র কতকগুলো কুলটা মেয়েমানুষের জন্য? এ কি হতে দেওয়া যায়, না হতে দিতে আছে? ঠিক বলেছেন ধর্মগুরু হোজাত ওল-এসলাম কাজেম সেদিকি। ইরান-এর যে সব মহিলা ঠিকঠাক পোশাক পরে না, মাথা ঢাকা দেয় না, অসভ্য জামাকাপড় পরে নেচে বেড়িয়ে ছেলেদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়, সমাজে কাঁড়ি কাঁড়ি পাপ ডেকে আনে, মানে দুশ্চরিত্রা আর কী— ঠিক, ঠিক ওই ক’টা মেয়ের ওপর বেজায় খেপে গিয়েই কিনা ঈশ্বর এই শাস্তিটা দিলেন। না হলে ইরানের মতো দেশের কি এমন ভূমিকম্প প্রাপ্য ছিল?
এক্কেবারে ঠিক। আমরা কি আর জানি না, জাপানে যে এত বড় সুনামি হল কিংবা আমেরিকায় যে মাঝে মাঝে ভূমিকম্প, বিধ্বংসী ঝড় হয়ে কত কত লোকের সর্বনাশ হয়— এ সব কাদের জন্য? ওই কিছু অসভ্য, খারাপ মেয়ের জন্য। না হলে পৃথিবীতে এ রকম খারাপ জিনিস কেন ঘটবে? ঈশ্বর এক জন চমৎকার লোক, যিনি কিনা খুশি হলে সবাইকে পুরস্কৃত করেন আর রেগে গেলে এই রকম প্রলয় পাঠান শাস্তি হিসেবে। ইরানের ধর্মগুরুকে একা দোষ দিয়ে তো লাভ নেই, বেশির ভাগ পুরুষই ভাবেন, পৃথিবীটা যে মোটামুটি রসাতলে গিয়েছে, তার জন্য দায়ী মেয়েরাই।
আর এখানেই আমাদের জিত। একমাত্র মেয়েরাই পারে পৃথিবীর পবিত্রতা রক্ষা করতে কিংবা রসাতলে পাঠাতে— দারুণ ব্যাপার না? এই রকম একটা স্টিয়ারিং যে মেয়েদের হাতে রয়েছে, সেটাতে সত্যি গর্ব বোধ হয়। |
কী ক্ষমতা তাদের দিয়ে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন, তিনি নিজেও বোধ করি ঠিক বোঝেননি। সেই যে ইডেন গার্ডেন-এ ইভ আপেলটি নিয়ে এসে খাইয়ে দিল আদমকে, সেই থেকে রসাতলে পাঠানোর সব দায় মেয়েরা নিয়ে নিল। আদম বেচারা তো কিছুই জানত না, এমনকী নিজে আপেল উল্টে খেতেও জানত না। তার পর ধরা যাক হেলেন অব ট্রয়, কী সব তুকতাক করল আর খামখা যুদ্ধ লেগে গেল দুটো দেশের মধ্যে। তার পর ধরুন সীতা, রাবণ ব্যাটা উঠিয়ে নিয়ে গেল, আর রাম বেচারা খেটেখুটে যুদ্ধ করে উদ্ধার করল, তবে কিনা রামায়ণ লেখা হল। তা না হলে কী হত, চোদ্দো বছর বনে থেকে ড্যাং ড্যাং করে অযোধ্যা ফিরে আসত আর নটে গাছটি মুড়িয়ে যেত। যদিও সীতা নিজে কোনও অনাচার করেননি, কিন্তু রাবণ এসে সীতাকে তুলে নিয়ে গেল, অপবিত্র করে দিল, তার দায়টা তো সীতাকেই নিতে হবে, মেয়ে তো! প্রত্যক্ষ হোক, পরোক্ষ হোক, এই ঝঞ্ঝাটের মহিলাগুলো ছিল বলেই কিনা এত ঝামেলা, এত পাপ আর এত রসাতল।
তবে, ইরানের ধর্মগুরুর কথা শুনে কিন্তু নিজেকে বেশ সুপ্রিমো মনে হচ্ছে। মেয়েদের কী অস্সাআআধারণ ক্ষমতা ভাবুন তো! কিছুটা ‘দুশ্চরিত্রা’ হলে যদি প্রকৃতির ওপর ছড়ি ঘোরানো যায়, সে দাপটের কোনও মার আছে? কী হবে ছুটকোছাটকা কর্পোরেটের সি ই ও কিংবা রাজনীতির হত্তাকত্তা হয়ে। একটু যদি কুমির-তোমার-জল-কে-নেমেছি স্টাইলে পাপে নামি, অমনি জবরদস্ত টেকটনিক মুভমেন্ট! যে ক্ষমতায় বিধাতা নিমেষে টলায়মান, তার জন্য অল্প খারাপ হলেই বা ক্ষতি কী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইরান ফল্ট জোন-এ অবস্থিত প্রাকৃতিক কারণে, তাই বিপর্যয়। কিন্তু আসলে তো মেয়েরা পাপ করে ইরানকে টেনে আনল ফল্ট জোন-এর ওপর, তবেই না ভূমিকম্প হল। আহ্! এই সর্বময় ক্ষমতার কী সোয়াদ। চোখ বুজে ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। আজ নাইট ক্লাব গেলাম, কলকাতায় সুনামি। কাল শর্ট স্কার্ট পরলাম, গঙ্গা ফুলে উঠে ভেঙে দিল সেকেন্ড হুগলি ব্রিজ। পরশু লাল পাড়-সাদা শাড়ি পরে লক্ষ্মী-পাঁচালি পড়লাম, কলকাতার রাস্তায় ‘আয় আয় মন্ডামিঠাই হাঁড়ি হাঁড়ি’। এ তো যে কোনও নেশার চেয়েও কাঙ্ক্ষিত, যে কোনও মিসাইলের চেয়েও অব্যর্থ।
বেচারা পুরুষ, কেবল খবরদারি করা ছাড়া আর কোনও ক্ষমতাই তার নেই। আমি আজ পর্যন্ত শুনিনি যে পুরুষরা ধর্ষণ করে বলে সমাজে পচন ধরছে। সমাজ খারাপ হয়েছে ধর্ষিতার চরিত্র খারাপ বলে। দিল্লিতে কয়েক মাস আগে সেই ভয়াবহ ঘটনার পরে আমাদের আসারাম বাপু বললেন, মেয়েটি যদি সরস্বতী মন্ত্র জপ করে ছেলেগুলোর হাতে-পায়ে ধরে বলত ‘আমি তোমাদের বোন’, তা হলে আর ধর্ষণ হত না। কিন্তু তা বললে কি হয়? আসারাম বাপু ভালমানুষ, উনি অতশত জানেন না— অত রাতে মেয়েটি পুরুষবন্ধুর সঙ্গে বেরিয়েছিল যে! খারাপ-মেয়ের ডিকশনারিতে সতেরো নম্বর পয়েন্ট তো এটাই— প্রযোজ্য সবার জন্য, সে মা হোক আর বোন হোক। আবার ধরুন, পরপুরুষের সঙ্গে প্রেম তো শুধু মেয়েরাই করে, সেই পুরুষটা তো করে না। তাই তার চরিত্রও খারাপ হয় না। বেচারারা— এমন কোনও বিধানই নেই, যা সে অমান্য করতে পারে। এমন কোনও গণ্ডিই বরাদ্দ হয়নি তার জন্যে, যা পেরোলে লণ্ডভণ্ড অবশ্যম্ভাবী।
আর মেয়েদের এই সব পাপের স্খালন? নগ্ন করে হাঁটানো, গণপিটুনি, খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দমদম দাওয়াই... হবেই তো। যে অপরাধে ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, জলোচ্ছ্বাস, সব কিছু হতে পারে, তার কঠোরতম শাস্তি হবে না? অতএব এতদ্দ্বারা প্রমাণিত হইল যে— রসাতল মেয়েরাই নির্মাণ করে। উপপাদ্যয়-উপপাদ্যয় মিলে গেল। নিরুপায় পুরুষ মেয়েদের আয়েসে-তৈরি-করা পাপভূমিতে ডুবে যেতে বাধ্য হল। না নিজেরা অধিকতর রসাতল বানাতে পারল, না পবিত্রতা আমদানি করে কাটাকুটি করতে পারল।
পারবেই বা কী করে? পবিত্রতা রক্ষার হোলসেল ইজারা তো মেয়েরা সেই কবে থেকে দখল করে বসে আছে। সতী বলেই না সাবিত্রী ভেলায় চড়ে কোথায় কোথায় গিয়ে সত্যবানের প্রাণ ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন, পবিত্র বলে সীতা আগুন ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। এখনকার মেয়েদের অবিশ্যি সে-সব কিছুই করতে হয় না। তাদের পবিত্রতার মাপকাঠি হচ্ছে শেমিজের মতো ঢাকা পোশাক, সন্ধে সাতটার মধ্যে বাড়ি, নো পুরুষবন্ধু আর নিটোল-নিখুঁত সতীচ্ছদ। ব্যস, এইটুকু বজায় থাকলেই সমাজ পুষ্পক রথে চড়ে স্বর্গে যাবে, দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করবেন। আর বেচারি পুরুষ? সে পবিত্র থাকল কি না, ‘উগ্র’ ‘অশালীন’ পোশাক পরে সন্ধের ঝোঁকে গড়িয়াহাটে হেঁটে এল কি না, তা নিয়ে দেবতারা গুরুরা বাবাজিরা মোটেই চিন্তিত নন। মানে, পবিত্রতার স্টিয়ারিংও ফের সেই মেয়েদের হাতে চলে গেল, উপপাদ্যয়-উপপাদ্যয় মিলে গেল। মিলবেই তো— যার হাতে পাপের অস্ত্র, তার হাতেই তো পুণ্যের রক্ষাকবচ।
পরিশেষে, একটাই উপদেশ— পুরুষরা, কাজকম্ম ছেড়ে কেবল মেয়েদের ওপর কড়া শাসন জারি রাখতে নিজেদের নিয়োজিত করুন। দেশের, দশের, জাতির ভাল হবে। কোন মেয়ের মনে কী আছে বলা যায়? কখন একটু পাপ করে বসবে, আর ও দিকে আপনি দিব্য ফিরছিলেন অফিস থেকে, অ্যায়সা ঝড় তুলে দিল যে গাছটা আপনার ঠিক এক আঙুল পাশে ভেঙে পড়ল। তখন? যদি খবরদারিতে, নজরদারিতে ফাঁকি পড়ে যায়, আর মেয়েরা পাপ করেই চলে, তবে? এক জন আদর্শ নাগরিক হিসেবে প্রকৃতি আর সমাজকে বাঁচানোর দায়িত্ব কি আপনার নেই? |