সাত থেকে বেড়ে ২৪। এক বছরে রোগী-মৃত্যুর সংখ্যাটা তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। কারও হৃদ্যন্ত্রের অসুখ, কারও কিডনি বিকল, কারও ফুসফুসে সংক্রমণ। কেউ বা গলায় কিছু বিঁধে প্রাণ হারিয়েছেন। মিল একটাই জায়গায়। অভিযোগ, এঁদের অধিকাংশই মারা গিয়েছেন কার্যত বিনা চিকিৎসায়। কলকাতার পাভলভ মানসিক হাসপাতালে রোগীদের এই দুর্দশার ছবি উঠে এসেছে স্বাস্থ্য দফতরেরই নিজস্ব নথিতে। অভিযোগ উঠেছে, এমনিতেই মানসিক হাসপাতালের রোগীদের শারীরিক রোগের চিকিৎসা পুরোপুরি অবহেলিত থাকে। পাভলভের ঘটনা তারই নজির। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর।
২০১০ সালে পাভলভে রোগী-মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১০। ওই বছরেই হাসপাতালের বিভিন্ন পরিষেবা নিয়ে নানা অভিযোগ সামনে আসায় কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেন। স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ মানছেন, ওই হইচইয়ের কারণেই সাময়িক ভাবে উন্নত হয় পরিষেবার মান। প্রাপ্য যত্নের অন্তত কিছুটা বরাতে জোটে রোগীদের। ফলে ২০১১-য় মৃতের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় সাতে। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ২০১২-য় ওই সংখ্যাই বেড়ে হয় ২৪। কী ভাবে এক ধাক্কায় মৃতের সংখ্যা এতটা বেড়ে গেল, তার জবাব চেয়ে স্বাস্থ্য দফতরে অভিযোগ করে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তার ভিত্তিতে শুরু হয় তদন্তও। আর তাতেই ধরা পড়েছে, সামগ্রিক ভাবে রোগীদের স্বাস্থ্যের দুরবস্থাই এর কারণ। হার্টের অসুখ, কিডনির অসুখ, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের সংক্রমণ, ডায়াবেটিসের মতো সমস্যায় দিনের পর দিন কোনও চিকিৎসাই হয়নি বলে অভিযোগ। একাধিক রোগীর রক্তে সংক্রমণও (সেপ্টিসেমিয়া) ছড়িয়েছিল। এই ২৪ জনের মধ্যে ছ’জনের ময়না-তদন্তও হয়। যদিও কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ময়না-তদন্তের রিপোর্ট তাঁদের হাতে আসেনি। শুধু ২০১২-র মৃত্যু নয়, স্বাস্থ্যকর্তারা গত তিন বছরের কোনওটির ক্ষেত্রেই একটি ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও কী রয়েছে, তা জানাতে পারেননি।
কেন ২০১০ সালের ময়না-তদন্তের রিপোর্টও এখনও তাঁদের হাতে এল না? এর কোনও জবাব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা স্বাস্থ্য ভবনের কর্তাদের কাছে মেলেনি। পাভলভের সুপার রাঘবেশ মজুমদার এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, “এ নিয়ে কথা বলা বারণ আছে।”
স্বাস্থ্য দফতরের অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “বিষয়টা উদ্বেগের। তিন সদস্যের একটি দল গঠন করে তদন্ত চলছে। পরিষেবাগত কোনও অবহেলা বরদাস্ত করা হবে না।”
গত তিন বছরে রাজ্যের অন্যান্য মানসিক হাসপাতালে রোগী-মৃত্যুর সংখ্যা কেমন? ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রিতে কোনও রোগীর মৃত্যু হয়নি। পুরুলিয়ার ইনস্টিটিউট ফর মেন্টাল কেয়ার-এ তিন বছরে সংখ্যাটা যথাক্রমে ৮, ৫ এবং ২। বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে সংখ্যাটা ৭, ৩ এবং ৪। লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে ৫, ২ এবং ৭।
সম্প্রতি এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফে তথ্যের অধিকার আইনে স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে রাজ্যের মানসিক হাসপাতালগুলির হাল সংক্রান্ত কিছু প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়। ওই প্রশ্নগুলির জবাবেও স্বাস্থ্য দফতর কার্যত স্বীকার করে নেয় পাভলভে রোগীদের দুরবস্থার কথা। আর তাতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলির মধ্যে। পাভলভের চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ মনে করছেন, এটা কোনও নতুন তথ্য নয়। এখন বিষয়টা সামনে আসছে বলে হইচই হচ্ছে। এক চিকিৎসক বলেন, “এক রোগী শ্বাসকষ্টে ছটফট করতেন। আমরা বার বার কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম যাতে তাঁরা ওঁকে কোনও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করান। তিন-চার দিন নিয়ে যাওয়ার কথা ঠিক হয়েও অ্যাম্বুল্যান্স পাওয়া গেল না। পরে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করে যে দিন ন্যাশনাল মেডিক্যালে নেওয়া হল, সে দিন সেখানে বলা হল, ভর্তি করা দরকার। কিন্তু বেড নেই। দিন কয়েক পরে আসতে বলা হল। কিন্তু সেই ‘পরে’ আর আসেনি। কেউ নিয়ে না যাওয়ায় বিনা চিকিৎসায় ওই রোগী মারা যান।” |