|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
শিকড়ে ফেরানোর উদ্যোগ |
ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী |
ইমেজিং ওড়িশা, খণ্ড ১-২, প্রফুল্ল (ভুবনেশ্বর)। মোট ৮,৮০০.০০ |
কালাহান্ডি, কোরাপুট কি বলাঙ্গির-এর নাম কেন সংবাদমাধ্যমে উঠে আসে? অপরিসীম দারিদ্র, অনাহার, দুর্ভিক্ষ এ সবের জন্য, না কালাহান্ডির ঐতিহ্যবাহী নৃত্য-গীত শৈলী ‘ঘুমরা’, কোরাপুটের কোটপাড় শাড়ি বা বলাঙ্গিরের বোমকাই শাড়ির বিশিষ্টতার জন্য? প্রথমটাই সত্যি, খেদ প্রকাশ করেছেন প্রসন্নকুমার দাশ, ওড়িয়া সংস্কৃতির বহু ক্ষেত্রে যাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। সেই খেদ মেটাতে এক বিপুল আন্তর্জাতিক উদ্যোগে তিনি শামিল করতে পেরেছেন ২৭ জন বিদেশি সহ মোট ৬৫ জন গবেষককে, মুখ্য সম্পাদকের দায়িত্বে রাজি করিয়েছেন প্রবীণ ভারতবিদ এবং ওড়িশা বিশেষজ্ঞ হেরমান কুলকে-কে, সম্পাদকমণ্ডলীতে পেয়েছেন নিবেদিতা মহান্তি, গগনেন্দ্রনাথ দাশ ও দীননাথ পাঠীকে, এবং শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করেছেন দুই খণ্ডে ৯০০ পাতার মহাগ্রন্থ ইমেজিং ওড়িশা। দেড়শোরও বেশি ছোট-বড় লেখা আর ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট, কোপেনহাগেন, রিটবার্গের মতো বিদেশি মিউজিয়ম, দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়ম, কি ওড়িশার স্টেট মিউজিয়ম সহ নানা ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে নেওয়া অজস্র দুর্লভ ছবিতে এই বই সত্যিই ওড়িয়া শিল্প-সংস্কৃতির ‘ম্যাগনাম ওপাস’ হয়ে উঠেছে। ভারতের কোনও রাজ্য নিয়ে, বিষয়ের ব্যাপ্তি ও গভীরতার সঙ্গে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ফলগুলি একত্র করে এর তুলনীয় কোনও কাজ খুব কম হয়েছে।
কোনও ভৌগোলিক অঞ্চলের সার্বিক পরিচয় তুলে ধরতে গেলে, বিশেষ করে যেখানে অপরিচয়ের বাধা পদে পদে, কিছুটা ধরাবাঁধা পথে হাঁটতেই হয়। সে ভাবেই এগিয়েছে এই বইয়ের গড়ন— প্রাগিতিহাস থেকে অধুনাতনের দিকে। প্রথম খণ্ডে ইতিহাস, ধর্ম, ভাস্কর্য-স্থাপত্য, দ্বিতীয় খণ্ডে ভাষা-সাহিত্য, প্রদর্শনমূলক শিল্পকলা, উৎসব, দৃশ্যকলা, বস্ত্রশিল্প, রন্ধনশিল্প ও প্রাকৃতিক ঐতিহ্য। কিন্তু ইতিহাসের চেনাজানা প্রধান সড়ক ধরে পরিক্রমা যেমন চলেছে, তার মধ্যেই পাঠককে হাত ধরে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় নিষ্প্রদীপ অলিগলিতে। হেরমান কুলকে যেমন প্রথম খণ্ডে তাঁর ভূমিকায় বলেছেন, বইয়ের নাম ইচ্ছা করেই ‘ইম্যাজিন্ড ওড়িশা’ রাখা হয়নি। এই বই রেডিমেড ইতিহাস তুলে ধরে না, বরং ইতিহাসকে নতুন ভাবে ভাবতে পাঠককে উৎসাহিত করে। খুঁটিনাটি অজস্র উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মধ্যে আছে গুহাচিত্র বা তাম্রশাসন থেকে মুঘল ও মারাঠা-শাসিত ওড়িশায় খুর্দা রাজবংশের সঙ্গে গড়জাত রাজ্যগুলির সম্পর্ক, ঔপনিবেশিকতার সূচনাপর্বে অঙ্কিত ওড়িশা চিত্রাবলি (কলিন ম্যাকেঞ্জি সংগ্রহের অনেক দুর্লভ ছবি এখানে ছাপা হয়েছে), চৌষট্টি যোগিনীর মন্দির, জ্যোতির্বিদ চন্দ্রশেখর সিংহসামন্ত হরিচন্দন মহাপাত্র, রাজন্য-শাসিত ওড়িশার বিভিন্ন রাজ্য, ওড়িশার (লোক) দেবী, ওড়িশায় শিখধর্ম, ওড়িয়া ভাগবত, পই, চৌতিশা, লক্ষ্মীপুরাণ, প্রদর্শন শিল্পের মধ্যে মাহারি ও গোটিপুয়া, সখিনাট, প্রহ্লাদনাটক, রাবণছায়া, ঘুমরা, পালা ও যাত্রা, মঙ্গলনাট, দণ্ডনাট, রামলীলা, মুঘল তামশা, উৎসবের মধ্যে রাজাপর্ব, রণপুর দোলমেলন, ওলাসুনি মেলা, ঠাকুরাণী যাত্রা, ধনু যাত্রা, দৃশ্যকলার মধ্যে চিত্রকরদের কথা, বিশেষ করে কোপেনহাগেন মিউজিয়মে রক্ষিত ‘যাত্রীপট’-এর আলোচনা, পুঁথিচিত্র, আলপনা, রন্ধনশিল্পে ছানাপোড়া-র সঙ্গে জগন্নাথের ভোগের মেনু ইত্যাদি কত কী। সব কিছু এখানে ধরা গিয়েছে এমন দাবি সম্পাদকরা করেননি, বরং দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় নিবেদিতা মহান্তি বলেছেন, স্থানাভাবে তাঁদের বাছাই করতে হয়েছে।
কুলকে তাঁর ভূমিকায় জোর দিয়েছেন ওড়িশার ইতিহাস-সংস্কৃতির বহুকেন্দ্রিকতাজাত বৈচিত্র এবং জনজাতীয় ও হিন্দু সমাজ-সংস্কৃতির ধারাবাহিক বিনিময় ও আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার ওপর। এক দিকে যেমন উত্তর তোশালির ভৌমকর-রা নিয়ে এলেন বিহার-বাংলার পাল রাজাদের বৌদ্ধ শিল্পধারা, দক্ষিণ কোশলের সোমবংশীরা আনলেন মধ্যভারতীয় শৈলী, তেমনই গঙ্গ-রা এনেছিলেন দক্ষিণী ভাষা ও স্থাপত্যের প্রভাব। এদিকে সংস্কৃতির পারস্পরিকতার সব থেকে বড় নজির তো জগন্নাথ ‘কাল্ট’। আজও সেই ট্র্যাডিশন যে অক্ষুণ্ণ তা বোঝা যায় চার দশক আগেও কেওনঝড়ের বনদেবী, ঘাটগাঁও-এর ‘তারিণী’র ক্রমবর্ধমান মাহাত্ম্যে। সব মিলিয়ে এই বই ওড়িশার যে ঐতিহ্য তুলে ধরেছে, তা প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের গর্বিত করে বইকী। |
|
|
|
|
|