শনিবারের নিবন্ধ ১...
ওরা আসে...
ভূতের কথা উঠলেই দেখেছি, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী সবাই নড়েচড়ে বসে। যে বিশ্বাস করে না তারও ভুতুড়ে গল্প শুনতে প্রবল আগ্রহ। শুধু একটাই মুশকিল হয়, অবিশ্বাসীরা গল্পটা শোনার পর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা খাড়া করে ভূতকে নস্যাৎ করতে চায়। আমি বলি কী, বিশ্বাসও করতে পারেন, অবিশ্বাসও করতে পারেন। সে আপনার অভিরুচি, শুধু ব্যাখ্যাটা দিতে যাবেন না, ওই ব্যাখ্যাটাই অসহ্য।
বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের মধ্যে ভূতের ভয়ে ভীত মানুষ অনেক খুঁজে পাওয়া যাবে। সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষের এক সময় ঈশ্বরবিশ্বাস ছিল না, কিন্তু ভূতে ছিল প্রবল ভয়। এই ভয় ছিল আমার বিখ্যাত বন্ধু সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজেরও, যে ছিল প্রবল রকমের নাস্তিক। আসলে ভয় জিনিসটাই ও রকম, যেটাকে বিদ্যাবত্তা দিয়ে, যৌক্তিকতা দিয়ে, বিশ্বাস দিয়ে তাড়ানো যায় না।
ভূত দেখার মধ্যে অবশ্যই ভুল দেখা বিস্তর থাকে। গাঁ-গঞ্জের মানুষেরা এই সব ভুল দেখার শিকার হন বেশি। সঙ্গে নানা কুসংস্কার আছে। ওঝা-বদ্যিদের প্রচার আছে। অশিক্ষা ও অন্ধবিশ্বাস তো আছেই। তাই ভূত-দেখার গল্পের বেশির ভাগ গল্পই আসলে ভুল দেখা ও ভুল বোঝার গল্প।
তা হলে কি ধরে নিতে হবে যে, ভুল দেখাই আসলে ভূত দেখা? তা হলে কি ভূত বলে আসলে সত্যিই কিছু নেই? দেহাবসানের পর আর কিছুই থাকে না অবশিষ্ট? আত্মা বা অশরীরী-অস্তিত্ব এক অলীক ধারণা মাত্র? তথাকথিত যুক্তিবাদীদের বিশ্বাস তাই। ভূত-ভগবান-আত্মা-অশরীরী সবই ফক্কিকারি।
মুশকিল হল, ও ধরনের ধারণাও একটা বিশ্বাস মাত্র। নাস্তিকের ভূত বা ভগবান নেই। কেন নেই? জিজ্ঞেস করলে তাঁরা যা বলবেন, সেটাও এক বিশ্বাসেরই কথা। অনেকে বিজ্ঞানকেও টেনে আনেন, তাঁদের সপক্ষে। কিন্তু সমস্যা হল, বিজ্ঞান এ যাবৎ যত দূর এগিয়েছে তাতে, বিশ্বরহস্যের, জীবনরহস্যের নিহিত সত্যের নাগাল এখনও অধরা। আর বিজ্ঞানের কাজও নয়, ভূত বা ভগবান বিষয়ক চর্চা। জড়বস্তুই তার অন্বেষণ এবং গবেষণার বিষয়, এর বাইরে যাবেই বা কেন এবং কী ভাবে?
একবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল আমারই জীবনে। তখন আমি যোধপুর পার্কেরই আরেক প্রান্তে একটা ফ্ল্যাটে থাকি। তিন তলায়। সেখানে চারদিকেই বস্তি। সুতরাং খুব নির্জন জায়গা নয়। কিন্তু ওই ফ্ল্যাটে থাকাকালীন আমার মাঝে মাঝে একটু অস্বস্তিকর অনুভূতি হত। একদিন একটা ব্যাপার ঘটেছিল, সেটা খুবই অস্বাভাবিক।
তখন সন্ধে সাড়ে সাতটা-আটটা হবে। ছুটির দিন। বাড়িতে আমি ছাড়া কেউ নেই। আমার স্ত্রী গিয়েছেন নীচের তলার ফ্ল্যাটে গল্প করতে। আমি চা করব বলে আমার ঘর আর বাইরের ঘরের মধ্যবর্তী রান্নাঘরে চা করতে এসেছি। সে সময়ে চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম, বাইরের ঘর থেকে কে যেন হেঁটে আমার ঘরের দিকে গেল। আমি ধরে নিলাম আমার স্ত্রী ফিরে এসেছেন। আমি তাঁকে উদ্দেশ্য করে কথাও বলছিলাম। সাংসারিক কথাই। কোনও জবাব পাচ্ছিলাম না। আমি ধরে নিলাম তিনি বাথরুমে গিয়েছেন। তার পর চা করে এসে ঘরে ঢুকে আমি তো হা।ঁ ঘরে বা বাথরুমে কোথাও কেউ নেই। সারা ফ্ল্যাটেও কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না। কেমন একটা খটকা লাগল মনে। তা হলে কি আমরা ছাড়াও এই ফ্ল্যাটে আরও কেউ আছে? যার কথা আমার মেয়েও মাঝে মাঝে বলে! মেয়ে বেশ কয়েক বারই বলেছে, “বাবা এই ফ্ল্যাটে কিন্তু ভূত আছে। আমি টের পাই।” সেটা অবশ্য আমার স্ত্রীকেও মাঝে মাঝে বলতে শুনেছি। কিন্তু সে দিনের অনুভূতি আমাদের তিন জনকেই কেমন যেন এক সারিতে বসিয়ে দিল!
নাস্তিকদের বিশ্বাস, ভগবান নেই, ভূত নেই, পরলোক নেই। এটা বিশ্বাসই, বিশ্বাস ছাড়া ওই ধারণা আর কিছু নয়। আস্তিকেরও তাই। তার ভূত, ভগবান বা পরলোকের অস্তিত্ব বিশ্বাস মাত্র।
আমাদের ইন্দ্রিয়াদির কাছে গোদা বাস্তবতার অতিরিক্ত কিছু ধরা দেয় না বড় একটা। তাই আমরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার ওপরে যেতে পারি না। তবে মানুষের মন বিচিত্র জিনিস। মন নানা ধারণার বর্ণালি সৃষ্টি করে নিতে পারে এবং অনেক সময় তা সত্যের মতো প্রতীয়মান হয়। আর এই গোটা প্রক্রিয়াটা, মানুষের অস্তিত্বের বাস্তব ও মায়াময়তার আলোছায়া প্রকৃত সত্যকে আরও ঘেঁটে গুলিয়ে দেয়।
মৃত্যু বিষয়ে কৌতূহলের বশে আমি ‘নিয়ার ডেথ’ এক্সপিরিয়েন্স বিষয়ে কয়েকটা বই পড়েছি। মহিলা এবং পুরুষের লেখা বইগুলির বেশির ভাগই বিদেশে বেস্ট সেলার। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে এবং হয়। মৃত্যুর কাছে গিয়ে বা অল্প সময়ের জন্য মারা যাওয়ার পর চিকিৎসকের কৃতিত্বে ফের বেঁচে উঠে কেউ কেউ তাঁদের অনুভূত অবস্থানের বিষয়ে লিখেছেন। যাঁরা অবিশ্বাসী তাঁরা হয়তো অম্লানবদনে বলবেন বানিয়ে লেখা। মিথ্যে কথা। চিকিৎসকরা হয়তো বলবেন, মানুষের মস্তিস্ক এক বিচিত্র জিনিস, তা অনেক কিছু বিনির্মাণ করে নেয়, যা সত্য নয়। এ সবও আবার সেই বিশ্বাস বা ধারণারই কথা, প্রমাণিত সত্য নয়।
বছর তিরিশ বত্রিশের এক যুবক ডাক্তার একদিন আর এক জন প্রবীণ ডাক্তারের কাছে তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন, আমি শুনছিলাম। যুবক ডাক্তারটি হৃদরোগী। খুব সম্প্রতি তার একটি জটিল শল্য চিকিৎসা হয় হৃদযন্ত্রের। অপারেশনের সময় তিন মিনিটের জন্য তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। ভাগ্যক্রমে জীবনদায়ী প্রক্রিয়ায় তিনি আবার বেঁচে ওঠেন। কিন্তু সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেও তিনি নাকি ওই তিন মিনিট মৃত্যুর সময় এক পরাবাস্তব চৈতন্য লাভ করেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ওই তিন মিনিট তিনি এক অখণ্ড প্রশান্তির রাজ্যে উপনীত হয়েছেন। এত প্রশান্তি, এত তৃপ্তি ও আনন্দ তিনি জীবৎকালে কোনও দিন টের পাননি। নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্সের বইগুলির মধ্যে কমবেশি অনেকটা এই রকম অনুভূতির কথাই পড়েছি সম্মুখে শান্তি পারাবার ...
আবার সত্যি মিথ্যে নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, তর্ক উঠবে, কয়েক বছর আগে কাগজে আমার কিছু ভূতের অভিজ্ঞতার কথা ছাপা হয়েছিল, কয়েক দিন পরে একটা চিঠিতে একজন আমাকে চ্যালেঞ্জ জানান, তাঁর বাড়িতে গিয়ে থেকে ব্যাপারটা প্রমাণ করার। চিঠি পড়ে তো আমি বিমূঢ়।
এসব প্রমাণ করার দায় কি আমার? আমি আমার কথা বলেছি। বিশ্বাস, অবিশ্বাস তো পাঠকের হাতে। শুধু বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, ভূতে বিশ্বাস যদি কুসংস্কার হয়ে থাকে তো, ভূতে অবিশ্বাসেরও কুসংস্কার হতে বাধা নেই বাপু।
নিতান্ত শিশু বয়স থেকেই ভূতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। এবং সে তো এক দিন-দু’দিনের কথা নয়, বছরের পর বছর সে আমাকে জানান দিয়ে গিয়েছে। তাদের বার্তা বহু বার বহু ভাবে আমার কাছে ধরা দিয়েছে। শুধু অবিশ্বাসের পাউডার মেখে সে সব উড়িয়ে দিই কী করে?
কেউ কেউ হয়তো বলবে, ওই এক অন্ধবিশ্বাসী, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন লোক। বলবে? বলুক, বহুৎ আচ্ছা।

অলঙ্করণ: শেখর রায়


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.