প্রায় ত্রিশ বছর পর থানার মালখানায় ‘বন্দি’ থাকার পরে সম্প্রতি তাঁর ঠাঁই হল মন্দিরে।
রানি ভবানী প্রতিষ্ঠিত রাজ রাজেশ্বরী মূর্তি পয়লা বৈশাখ আজিমগঞ্জ-জিয়াগঞ্জের বড়নগরে ওই মূর্তি প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে পাঁচ দিনের মেলা। ত্রিশ বছর জিয়াগঞ্জ থানার মালখানায় পড়ে থাকার পর মন্দিরের অছিপরিষদের তৎপরতাতেই আবার নবনির্মিত মন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হল মূর্তিটি। তবে কেবল মাত্র ঐতিহ্য মণ্ডিত রাজরাজেশ্বরীর পুজো দেওয়াই ওই উদ্যোগের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। কয়েকশো বছর আগে বড়নগর ছিল অবিভক্ত বাংলার অন্যতম বানিজ্যকেন্দ্র ও পর্যটনস্থল। পুজো ও মেলাকে ঘিরে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জের মৃত প্রায় পর্যটন শিল্পের উন্নতি ও প্রসার ঘটানোও আর একটি উদ্দেশ্য।
বছর তিরিশেক আগে রানিভবানীর বড়নগরের বাড়ি লাগোয়া প্রায় পরিত্যক্ত মন্দির থেকে চুরি হয়ে যায় পিতলের তৈরি রাজরাজেশ্বরী মূর্তি। কিছু দিন পর পুলিশ মূর্তিটি উদ্ধার করলেও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশের কাছ থেকে তখন ওই মূর্তি কেউ ফেরত নেননি। মন্দিরের দশা ক্রমে আরও খারাপ হয়। রানি ভবানীর বর্তমান বংশধর অশীতিপর বৃদ্ধা শুভশ্রী বাগচীর দান করা ৬ লক্ষ টাকায় সম্প্রতি মন্দির সংস্কার করা হয়। সেই মন্দিরে পুনরায় মূর্তি প্রতিষ্ঠার কথা ভাবা হলে দেখা দেয় আইনি জটিলতা। |
পুলিশের মালখানা থেকে ‘বেওয়ারিশ’ মূর্তি ফিরে পেতে গঠিত হয় ‘বড়নগর রাজরাজেশ্বরী দেবী অছি পরিষদ’। অছি পরিষদের সহসভাপতি সমীর ঘোষ বলেন, “রাজরাজেশ্বরী মূর্তি ফিরে পেতে লালবাগ মহকুমা আদালতে মামলা করা হয়। অছি পরিষদের হাতে ওই মূর্তি দেওয়ার জন্য মাস তিনেক আগে বিচারক নির্দেশ দেন।”
নাটোরের রানি ভবানীর রাজশাহি জমিদারির রাজধানী ছিল ভাগীরথীর পাড় লাগোয়া বড়নগর। বালবিধবা মেয়ে তারাকে নিয়ে জীবনের শেষভাগ তিনি বড়নগরেই কাটিয়েছেন। সেখানেই তিনি মারা যান। টেরাকোটার শিল্পে সমৃদ্ধ চারবাংলা মন্দির, ভবানীশ্বর মন্দির, দয়াময়ী মন্দির, গোপাল মন্দির, অষ্টভূজ গনেশের মন্দির, বিশ্বেশ্বর মন্দির ও দশভূজা রাজরাজেশ্বরী মন্দির-সহ আরও অনেক মন্দির বড়নগরে স্থাপন করেছিলেন মহারানি ভবানী। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের মতে, “বড়নগর মুর্শিদাবাদের বারাণসী। ইহার চারদিকই দেবমন্দিরে পরিপূর্ণ। দুই-চারি পদ অগ্রসর হইতে না-হইতেই একটি-না একটি দেবমন্দির দৃষ্টপথে পতিত হইবেই হইবে।.অন্নপূর্ণার ন্যায় রাজরাজেশ্বরীর ভবন হইতে কোনও ক্ষুধার্তই প্রত্যাবৃত্ত হয় না।”
পরিষদের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক তথা ইতিহাস অনুরাগী বিভূতিভূষণ দত্ত বলেন, “রানি ভবানীর বর্তমান বংশধর শুভশ্রী বাগচীর দেওয়া ৬ লক্ষ টাকায় ভগ্নপ্রায় রাজরাজেশ্বরী মন্দির সংস্কার করা হয়। দেবসেবার জন্য তার দান করা আরও পনেরো লক্ষ টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আছে। সেই টাকার সুদে রাজরাজেশ্বরীর নিয়মিত পুজো অর্চনা ও দেবসেবা করা হবে।” কেবল ইউরোপীয়রা নয়, জৈন, শিখ, পারসিক, বৈষ্ণব, ক্রিষ্টান-সহ বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান ও ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জে। সমীর ঘোষ বলেন, “তবুও পযর্টকরা মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের নশিপুরের কাঠগোলার বাগান দেখার পর ফিরে যায়। অথচ আর মাত্র ২-৩ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও নিদর্শন। সেই সব স্থানের প্রতি পর্যটকদের আকর্ষণ করাও রাজরাজেশ্বরীর মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।” |