|
|
|
|
|
|
আতঙ্কিত বেলুড় |
গুন্ডারাজ |
দেবাশিস দাশ |
ফের রক্তাক্ত বেলুড়!
চলছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই। লক্ষ্য রেলের ছাঁট লোহা নিলামের বাজার দখল করা। বিবাদ চলে ব্যবসায়ীদের থেকে ‘গুন্ডা ট্যাক্স’ বা ‘জিটি’ আদায় নিয়েও। কিছু দিন আগে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় লেনে নিজের বাড়ির সামনেই কিশোরী বারুই খুন হওয়ার পিছনে এটাই মূল কারণ বলে প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে হাওড়া সিটি পুলিশ। কিশোরী পুলিশের খাতায় ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’।
বেলুড়ে রয়েছে এশিয়ার অন্যতম ছাঁট লোহা কেনাবেচার বাজার বজরংবলি লোহা মার্কেট। এই বাজারের দখলকে কেন্দ্র করে খুনোখুনি শুরু হয় ন’য়ের দশকের আগে। ১৯৯১-এ ছাঁট লোহা ব্যবসায়ী প্রভাত ভট্টাচার্যকে খুনের ঘটনায় রাখাল দাস গ্রেফতার হওয়ার পরে বেশ কয়েক বছর বেলুড়ে রক্তপাত বন্ধ ছিল। দু’-এক জন দুষ্কৃতী মাথাচাড়া দিলেও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের তেমন সমস্যা হয়নি।
অবস্থার পরিবর্তন হয় ২০০৭-এ। সে বছর সরস্বতী পুজোর দিন ডনবস্কো স্কুলের কাছে কিষনলাল জৈন নামে এক ব্যবসায়ী খুন হন। পুলিশের অভিযোগ, গুন্ডা ট্যাক্স বা ‘জিটি’ না দেওয়ায় তিন রাজ্যের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তোলাবাজ অমিত চৌধুরী এই খুন করায়। এর পরে অমিত বেলুড়ের বহু ব্যবসায়ীকে ফোনে খুনের হুমকি দিয়ে এলাকায় নিজের রাজত্ব কায়েম করে। ওই সময় অমিতের প্রতিনিধি হিসেবে পলাশ দাস কিছু ব্যবসায়ীকে নিয়ে একটি ‘সিন্ডিকেট’ তৈরি করে। এই সিন্ডিকেটের কাজ ছিল অমিতকে গোপনে
‘জিটি’ পাঠানো।
|
|
অলংকরণ: অনুপ রায় |
হাওড়া সিটি পুলিশ সূত্রে খবর, পলাশ দাসের ভাগ্নে কিশোরী বারুই। বাগুইআটিতে বছর দশেক আগে হাওড়ার আর এক দুষ্কৃতী আপেলকে খুন করে উত্থান হয় পলাশের। এর পরে সল্টলেক স্টেডিয়াম-কাণ্ডে অস্ত্রশস্ত্র-সহ গ্রেফতার হয় সে। জেল থেকে ফিরে অমিতের সঙ্গে হাত মেলায় পলাশ। পুলিশ জানায়, ওই সময় তার সঙ্গে থেকে অপরাধ জগতে হাত পাকিয়েছিল কিশোরী। কিশোরী ছাড়াও পলাশের দলে ছিল শ্রীকান্ত মাহাতো, রাজেশ সিংহ, নানকি, বিজয় মাহাতোর মতো এলাকার কয়েক জন কুখ্যাত তোলাবাজ। পরে পলাশের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় শ্রীকান্ত ও রাজেশ বেরিয়ে গিয়ে আলাদা আলাদা দল করে।
পুলিশ সূত্রের খবর, বছর আটেক আগে পলাশ বাহিনীর হাতে খুন হয় তারই এক সময়ের সাগরেদ রাজেশের ভাই। অভিযোগ উঠেছিল, কিশোরীই রাজেশের ভাইকে খুন করে। এর বদলা হিসেবে ২০১১-র ২০ মে রাজেশ বাহিনীর হাতে খুন হয় পলাশ। ওই ঘটনায় রাজেশ এবং তার কয়েক জন সঙ্গী গ্রেফতার হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, পলাশ খুন হওয়ার পরে সিন্ডিকেট নষ্ট হয়ে যায়। এলাকা দখলের জন্য উঠে পড়ে লাগে শ্রীকান্ত মাহাতো। ছাঁট লোহা ব্যববসায়ীদের ফোনে হুমকি দিয়ে বোমাবাজি আর মারধর করে এলাকায় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। এই নিয়ে রাজেশ বাহিনীর সঙ্গে শ্রীকান্তের টক্কর শুরু হয়। পাশাপাশি মামা পলাশের পুরনো লোকদের নিয়েই দলের নেতৃত্ব দিতে শুরু করে কিশোরী।
পলাশ খুনের মামলায় মাস তিনেক আগে জামিন পায় রাজেশ। পরে একে একে ছাড়া পায় নানকি, গুপে, ক্যারাটে মনোজ, বট্টম রাজেশ, মুন্না যাদব-সহ পলাশ খুনের অন্য অভিযুক্তরা। গত ১৯ মার্চ রাতে মোটরসাইকেলে আসা দুষ্কৃতীদের সঙ্গে বাড়ির সামনে কিশোরীর বাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে কিশোরীর বুকে ও পেটে গুলি লাগে। হাওড়া হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। ওই সংঘর্ষে গুলিতে গুরুতর আহত হয় অন্য পক্ষের মুন্না নামে এক যুবক। মুন্না এখন হাওড়ার একটি নার্সিংহোমে চিকিৎসাধীন।
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের ধারণা, ভাইয়ের খুনের বদলা এবং এলাকা দখলের জন্যই রাজেশ বাহিনী কিশোরীকে খুন করেছে। মুন্না তার দলেরই লোক। পুলিশ ইতিমধ্যে যে দু’জনকে গ্রেফতার করেছে তারা রাজেশেরই লোক বলে জানা গিয়েছে। রাজেশের এই বাড়বাড়ন্তে চিন্তিত হাওড়া সিটি পুলিশও। কত দিনে বন্ধ হবে এই ‘গ্যাং ওয়ার’?
হাওড়ার পুলিশ কমিশনার অজেয় রানাডে বলেন, “গোটা এলাকায় নিয়মিত পুলিশি অভিযান হচ্ছে। সমস্ত দুষ্কৃতীকেই ধরা হবে। কেউ বাদ যাবে না। সাধারণ মানুষের চিন্তার কোনও কারণ নেই।” যদিও পুলিশের এক মহলের আশঙ্কা, বেলুড়ে খুনোখুনি এখনই থামবে না। একই আশঙ্কা করছেন ছাঁট ব্যবসায়ীদের একাংশও। তাঁদের আশঙ্কা, ব্যবসায়ীদের উপর তোলাবাজি বাড়বে। তাঁদের অভিযোগ, আগে শুধু দু’-এক জন ‘দাদা’কে তোলা দিলেই হয়ে যেত। এখন প্রতি দিনই নতুন নতুন ‘দাদা’ তৈরি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেলুড়ের এক লোহার ছাঁট ব্যবসায়ী বলেন, “এমনিতেই রেলের লোহার ছাঁট ব্যবসার বাজার আগের তুলনায় খারাপ হয়ে গিয়েছে। এর ওপর তোলাবাজদের দাপট অনেক বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসা লাটে উঠতে বসেছে। সকলেই এখন ‘জিটি’ চাইছে।” |
|
|
|
|
|