গণতন্ত্রে শাসক এবং বিরোধী পক্ষের পারস্পরিক ভূমিকা কী হওয়া উচিত? পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পাঠশালার ছাত্ররা বলিবেন, ‘কেন, শাসক যাহাই করুক, বিরোধী সর্বশক্তিতে তাহার বিরোধিতা করিবে আলাপ-আলোচনা, সমঝোতা নৈব নৈব চ’। পশ্চিমবঙ্গের পাঠশালার পড়ুয়ারা এই বিদ্যায় দেশে সর্বাগ্রগণ্য বটে, কিন্তু অন্যরাও খুব পিছাইয়া ছিলেন বলিলে তাঁহাদের প্রতি অন্যায় হইবে। ইউ পি এ-র দ্বিতীয় দফায় বিজেপি নেতারা কত দিন সংসদ চলিতে দিয়াছিলেন? ‘বিরোধী’ পরিচয়টিকে ভারতীয় রাজনীতিকরা বড় বেশি আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করিয়াছেন। আশা জাগিতেছে, জমি অধিগ্রহণ বিলটি এই বাস্তবে একটি বড় ব্যতিক্রম হইবে। বিলটি দীর্ঘ দিন যাবত্ সংসদ ভবনে ঘুরপাক খাইতেছে। অবশেষে আশা জাগিয়াছে, এই বাজেট অধিবেশনেই তাহা পাশ হইবে। সম্ভাবনাটি আকাশ হইতে পড়ে নাই প্রকৃত গণতন্ত্রের মাটিতে তাহার জন্ম। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন ইউ পি এ-র সহিত বিরোধীদের বহু মতপার্থক্য ছিল। কংগ্রেস সেই আপত্তি শুনিয়াছে। বহু ক্ষেত্রেই আপত্তি গ্রাহ্য করিয়া বিলে পরিবর্তন করিয়াছে। বিজেপি-র দলনেত্রী সুষমা স্বরাজ জানাইয়াছেন, তাঁহারা সন্তুষ্ট। বিলটিকে সমর্থন করিবেন। সিপিআইএম-এর পরামর্শও গ্রহণ করা হইয়াছে। ইহাই গণতন্ত্রের পাঠ আলোচনার মাধ্যমে, পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। এই প্রক্রিয়ায় শাসককে ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীল হইতে হয়, বিরোধীকে গঠনমূলক বিকল্পের সন্ধান করিতে হয়। এবং, কেহই নিজের অবস্থানে অনড় থাকিবার জেদ করিলে চলে না। বিজেপি আদৌ কথা রাখিবে কি না, ক্ষুদ্র স্বার্থ আসিয়া গণতন্ত্রের ফসলকে লইয়া যাইবে কি না, এই প্রশ্নগুলির উত্তর এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু গণতন্ত্রের মূল সুরটিকে এতখানি মর্যাদা দেওয়ার উদাহরণ সাম্প্রতিক ভারতে আর নাই।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পাঠশালার বর্তমান প্রধান পণ্ডিত অবশ্য এই সুপবনে বিশ্বাসী নহেন। জমি বিল লইয়া তাঁহার এখনও আপত্তি আছে। থাকিতেই পারে বিশেষত জেদ যখন যুক্তির ধার ধারে না। কিন্তু, তিনি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিজের আপত্তি জানাইতে অরাজি। জমি অধিগ্রহণ বিল বিষয়ের বৈঠকে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। এই ব্যাধিটি অবশ্য নূতন নহে। তাঁহারা যখন কেন্দ্রীয় সরকারের শরিক ছিলেন, তখনও বৈঠকে অনুপস্থিত থাকাই বঙ্গজ নব্য ‘বামপন্থী’দের রেওয়াজ ছিল। তাঁহারা মেঠো রাজনীতিকে সার মানিয়াছেন। ফলে, অন্যরা যখন নিজেদের আপত্তি জানাইতেছিলেন, বিকল্প পথ প্রস্তাব করিতেছিলেন, তখন তৃণমূল কংগ্রেস নিজেদের সযত্ন দূরে রাখিয়াছিল। অভিমান? হইবেও বা। রাজনীতিতে এই ঠুনকা অভিমানের স্থান নাই। দলনেত্রী নিজের আপত্তির কথা ঘোষণা করিয়াও জানাইয়াছেন যে তিনিও চাহেন এই বার বিলটি পাশ হউক। অস্যার্থ, বিরোধের জায়গাটি তিনি ছাড়িবেন না। তাহাতে সম্ভবত মেঠো বক্তৃতায় সমস্যা হইবে। ‘বিরোধী’ হিসাবে সত্যই তাঁহার জবাব নাই। কিন্তু জমি অধিগ্রহণ বিল বিষয়ে তাঁহার অবস্থান যাহাই হউক না কেন, বিলটি বর্তমান রূপে পাশ হইলে তাঁহার দায়িত্ব বাড়িতেছে। কেন্দ্রীয় সরকার, যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানের সম্মান রাখিয়াই, বহু প্রশ্নে সিদ্ধান্ত করিবার ক্ষমতা রাজ্যের হাতে ছাড়িয়াছে। জমি লিজের প্রসঙ্গই হউক, অথবা ক্ষতিপূরণের প্রকৃত পরিমাণ স্থির করা, রাজ্য সরকারের ভূমিকা তাত্পর্যপূর্ণ হইবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুশি হওয়া উচিত, কারণ তাঁহার রাজ্যে তিনি যেমন আইন চাহেন, তাহা রূপায়ণ করিতে পারিবেন। তবে সাবধান! কোন রাজ্য জমি অধিগ্রহণ বিষয়ে কী অবস্থান গ্রহণ করে, তাহার উপর সেই রাজ্যের ভবিষ্যত্ বহুলাংশে নির্ভরশীল হইবে। মমতাদেবী নিশ্চিত থাকিতে পারেন, বহু রাজ্যই শিল্পবান্ধব জমি অধিগ্রহণ নীতি গ্রহণ করিবে। মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম দুই বত্সরে, তাঁহার নিদারুণ জেদের দৌলতে, মমতাদেবী শিল্পমহলের সহিত বিপুল দূরত্ব রচনা করিয়া ফেলিয়াছেন। তাঁহার সম্মুখে আত্মশুদ্ধির সুবর্ণসুযোগ। রাজ্যের স্বার্থকে আপন জেদের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়া তিনি যদি জমি অধিগ্রহণের পথ সুগম করিবার বহুদলীয় উদ্যোগে যোগ দিতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গ বাঁচিবে। |