|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা ২... |
|
মন্তব্যে আর স্লোগানে মরে গেল দর্শকের উচ্ছ্বাস
পিসিভূত মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় অসাধারণ। তবু শেষ রক্ষা হল না। লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য |
‘গয়নার বাক্স’ একই সঙ্গে উপহার দিল দুই অপর্ণা সেনকে।
এক, সেই পরিচিত অপর্ণা, যিনি নারী-পুরুষ সম্পর্ক, সমাজ বা সময়ের কোনও সমস্যা, কোথাও কোনওখানে রাজনীতির কোনও মোচড় এবং চোখের জল নিয়ে ছবি করেন।
আর দুই, এক নতুন মেকওভারে অপর্ণা, যিনি হাসির হুল্লোড়ে, বাস্তব ও অবাস্তবের অবিরত মিশ্রণে, সরল, সাবলীল ঝকঝকে কথনে গড়ে নিচ্ছেন বাজার সফল হওয়ার মতো এক কমেডি অফ ম্যানার্স। কোনও বিশেষ কালের লোকজনের স্বভাবের আঁকবাঁক, আনাচকানাচ, অলিন্দে জমা রসের রসদ যে নাট্যরঙ্গে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে যে সময়টা তিনি ধরেছেন তা প্রধানত দেশ স্বাধীন হওয়ার সামান্য পরের। পরের অংশ দৌড়ে গিয়েছে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে, কী যুক্তিতে সে কথায় পরে আসা যাবেখ’ন। এবং জায়গাটা এপার বাংলার নতুনবাজার-নবাবগঞ্জর ছোটবড় হাসি, মেলা ঈর্ষা-হিংসে-কচাল, বংশের বড়াই, সম্পত্তির লড়াই, নকড়াছকড়া, আড়ালে আবডালে ফুর্তিফার্তা, বারদোষ, সব মিলিয়ে সুন্দর একটা সময়। তারও প্রায় সিংহভাগ ধরা পক্ষ বিস্তার করে দাঁড়ানো, তিন কাল খোয়ানো এক জমিদার বাড়িতে, যার গোড়ালি ঘিরে এক দিঘি জল।
অপর্ণা এই বাড়িটাকেই ব্যবহার করেছেন এক ক্যানভাসের মতো। ছোট্ট ছোট্ট আঁচড়ে, অজস্র ডিটেলে ভরানো আলোকালো (পড়ুন আলোআাঁধারি) ছবিতে। বাড়ির রহস্যময় যে-টঙে ঘর তার সব রহস্য জমা আছে এক গয়নার বাক্সে। যা পাহারা দেয় এক ভূত। সদ্য ভূত হওয়া সে-পিসিমা সবার কাছেই অদৃশ্য, দেখা দেন কেবল ভাইপো-গিন্নি হয়ে হালে পরিবারে যুক্ত হওয়া সোমলতাকে। যার জিম্মায় তিনি ন্যস্ত করে গিয়েছেন তাঁর পাঁচশো ভরি সোনার গয়নার বাক্স। |
|
গয়নার বাক্স
মৌসুমী, কঙ্কনা, শ্রাবন্তী, শাশ্বত |
পিসিমার ভূত টিপিক্যাল শীর্ষেন্দু মুখুজ্জে ঘরানার ভূত। এ বাড়ি-ও বাড়ি করা আর পাঁচটা মানুষের মতোই, কাণ্ড কিছু ঘটিয়ে চলেছেন, কিন্তু চাক্ষুষ হন না। এ ভূত সংসারের মায়া ত্যাগ করেছেন ঠিকই, কিন্তু গয়নার মায়া ত্যাগ করতে পারেননি।
সোমলতাই বাক্সের পাহারাদার, আর বাড়ি তোলপাড় হচ্ছে সে-গয়নার খোঁজে। দর্শক যখন উৎকণ্ঠায়, এই বুঝি বেরিয়ে পড়ল গয়নার বাক্স, তখনই খেল শুরু হল পিসিমার ভূতের। শুরু হয়ে গেল তিন পুরুষ জোড়া গয়নার বাক্সের আমুদে, ভুতুড়ে বৃত্তান্ত। ভয় কোথায়? সোমলতা আর এই ফিল্মের দর্শকরা ছাড়া তাকে তো কেউ দেখেই না, তাও দেখে এক পাতলা, ধোঁয়াটে নেগেটিভের মতো। দু’ঘণ্টা প্লাস ছবি ধরে এই বায়বীয় ভূতের সঙ্গ করা একটু ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে এক এক সময়। মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় অতি অপূর্ব অভিনয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন পিসির ভূতের চরিত্র, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হল না।
রাসমণির ভূতের মানসিক বিবর্তনও গল্পের একটি ধারা। অন্য ধারা প্রথম থেকেই আড়ষ্ট, তোতলামিতে পাওয়া ভাল মানুষ সোমলতার সক্ষম, স্বাধীন মহিলা হয়ে ওঠা। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু বাণিজ্যিক কারণে বর বোম্বাই যেতে পিসি যখন ভাইপো-গিন্নিকে অন্য পুরুষে মজতে উস্কানি দেন, তখনই ভূতের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন চড়তে শুরু করে। ভূতেরও তা হলে গয়না ছাড়াও অন্য অ্যাজান্ডা আছে!
বালবিধবা পিসি যৌবনকালে দারোয়ান রাম খিলোয়ানকে শয্যাসঙ্গী করতে গিয়েও হাতছাড়া করেছেন, তাই নীরব রফিকের কোলে সোমলতাকে গুঁজে দিতে তিনি মরিয়া। তবু রক্ষে সে কেচ্ছা গজায়নি। আর পরেই নায়িকার কোলে যে বাচ্চা এল, তার পিতৃপরিচয় নিয়ে ধন্দ গড়ায়নি।
এই মেয়ে চৈতালির মুখে পিসিমার মুখ বসানো। সিনেমায় তার যুবতী হয়ে উঠতে বেশি ফুটেজ লাগেনি, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, যা শীর্ষেন্দুর গল্পে নেই। চৈতালির বন্ধু বেণু মুক্তিযোদ্ধা, অস্ত্রশস্ত্রের জোগাড়যন্ত্রের জন্য চৈতালি মা’র হাত থেকে পাওয়া গয়নার বাক্স তুলে দিল বেণুর হাতে। যে-সাবেক গয়নার কেয়ারই করেনি অ্যাদ্দিন তা-ই হল সত্যকার স্ত্রী-ধন। কিন্তু ততক্ষণে দর্শকের উচ্ছ্বাসও মরে ভূত। মন্তব্য ও স্লোগান বাদ দিয়ে অপর্ণা যে এক বেদম হাসির ছবিও শেষ করতে পারলেন না, এটা একটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে রইল।
‘গয়নার বাক্স’ সিনেমা হিসেবে আ টেল টু লং। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে সলমন রুশদির উপন্যাসের ভিত্তিতে ওঁরই চিত্রনাট্যে গড়া ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ ছবিটাকে। নিজের উপন্যাস, তাই মায়া ছাড়তে না পেরে দীর্ঘ উপন্যাসের প্রায় সবটাই ঢেলে দিয়েছেন চিত্রনাট্যে। দৈবক্রমে সে-ছবিরও শেষ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে। কিন্তু তার একটা ঐতিহাসিক যুক্তিক্রম ও অনিবার্যতা আছে। গয়নার বাক্সের হিল্লে করতে যদি মুক্তিযুদ্ধ লেগে থাকে, তবে তার খেসারত একটু বেশি পড়ে গিয়েছে। তবু অপর্ণা সেনের ছবিতে একটা বক্তব্য থেকেই যায়। একটু বেশিই হয়তো। নারীর স্বনির্ভরতা, গয়নার বদলে বুদ্ধিকে স্ত্রীধন করা, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, ছোট বংশ-বড় বংশ, উঁচু বর্ণ-নিচু বর্ণ, নারীর অবদমিত যৌনাকাঙক্ষা, পুরুষের ভণ্ডামি, ইতরবিশেষে সবই ছড়িয়ে আছে ছবিময়। তাতে যে চলচ্চিত্র রসে টান পড়েছে তা’ও নয়, তবে ক্ষণে ক্ষণে কাহিনি ও ছবিতে পিসি ভূতের উদয় ও মুশকিল আসান হয়ে ওঠার মতো নানা সিকোয়েন্সে মেকওভার অপর্ণা সেনের জায়গায়, পরিচিত অপর্ণা সেন এসে পড়েন। হয়তো সেই অপর্ণা সেনই সাক্ষাৎকারে বলে দেন যে ছবিতে লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়্যালিজমের অনুপ্রবেশ আছে।
এত সবের পরেও বলব, আগের কথাটাই আবারও, অপর্ণা সেন ‘অপর্ণা সেন’। তন্ময় চক্রবর্তীর শিল্প নির্দেশনা, রবিরঞ্জন মৈত্রর সম্পাদনা এবং বিশেষ করে, সৌমিক হালদারের চমৎকার ক্যামেরায় ভর করে এক অভিনব জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। প্রায় এক কথা-বলা সমাজ-পরিবেশ।
আফশোসের এই যে, সঙ্গীত দিয়ে তেমন সহযোগিতা করা যায়নি ছবিকে। দেবজ্যোতি মিশ্র সুরারোপিত টাইটেল সংটা চনমনে, বাকি যা উচ্চাঙ্গ গান, রবীন্দ্রনাথ চণ্ডীদাস বিদ্যাপতি গাওয়ানো গিয়েছে তা কানে ধরেনি। শুভা মুদগলের গলা ভাল দেয়নি, ‘আমার সোনার বাংলা’ চলনসই।
ছবিতে মাতিয়েছেন বটে পিসিভূত মৌসুমী, তবু তো নব্বইভাগ ছায়া ছায়া থেকে। দিব্যি পাল্লা দিয়ে কাজ করে গিয়েছেন সোমলতারূপী কঙ্কনা। বেশি মন কেড়েছে ওঁর তোতলামি ভরা সংলাপগুলোই। পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা চরিত্র, অপরাজিত আঢ্যর বড় বউ, পীযূষের বড় ছেলে আর শাশ্বতর ছোট ছেলের চরিত্রে অভিনয় রীতিমতো জমাটি।
সত্যি বলতে কী, প্রায় নীরব চরিত্র যৌবনকালের পিসিমা হিসেবে অনেক বেশি দাগ কাটেন শ্রাবন্তী, পরে করা চৈতালি চরিত্রের থেকে। দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রে একই অভিনেত্রীকে ব্যবহার করার বিবেচনাটাই চমৎকার।
পুনশ্চ: শুনলাম, ছবির শেষ ছাব্বিশ মিনিট এডিট করে ছোট করে দেওয়া হচ্ছে। এই আলোচনা অবশ্য মূল ছবিটি দেখেই। |
|
|
|
|
|