|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
৩২০০০-এ ক’জন সোনা বেচেছিলেন? |
সোনার বাজারে একটা বুদ্বুদ তৈরি হয়েছিল। সবাই বিশ্বাস করছিলেন, সোনার দাম বাড়বে।
সেই বিশ্বাসের কোনও অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল না। কাজেই, বাজারে ধস অনিবার্যই ছিল। শুভদীপ নন্দী |
সোনার দাম হঠাত্ এতটা পড়ে যাওয়ায় অনেকেই স্তম্ভিত। যাঁরা সোনার চড়া বাজার দেখে সঞ্চয়ের অনেকখানি লগ্নি করেছিলেন সেই বাজারে, তাঁরা আর্থিক ক্ষতির মুখেও পড়লেন। অবশ্য, যাঁরা সোনার গয়না কিনতে ভালবাসেন, তাঁদের পক্ষে ভাল সময়! সোনার দামের এই ধসকে ‘অপ্রত্যাশিত’ বললে কিন্তু ভুল হবে। বাজারে সোনার দামের বুদ্বুদ তৈরি হয়েছিল, ২০০৮-এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জমি-বাড়ির বাজারের মতো। সোনার দাম যত বেড়েছিল, তার কোনও অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই। এখন সেই বুদ্বুদ ফাটতে আরম্ভ করেছে।
সে কথায় যাওয়ার আগে দুটো প্রশ্ন। এক, হঠাত্ এখনই কেন এই বুদ্বুদ ফাটল? বুদ্বুদ তৈরি হলে তা কোনও একটা সময় ফাটেই, একটা অব্যবহিত কারণ প্রয়োজন হয় মাত্র। এ ক্ষেত্রে প্রধান কারণ দুটো।
এক, আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, দেনার দায়ে জর্জরিত সাইপ্রাস তার সোনার ভাণ্ডারটি বাজারে বিক্রি করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইতালি, গ্রিস, স্পেনও হয়তো সোনা বেচবে। ফলে বাজারে সোনার জোগান হঠাত্ বেড়ে যেতে পারে।
দুই, শেয়ার বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ডাও জোন্স সূচক এখন সর্বকালের চড়া হারে আছে। ফলে, লোকে আবার শেয়ার বাজারে টাকা রাখতে সাহস করছে। নিরাপদ সম্পদ হিসেবে সোনার চাহিদা খানিক কমেছে। এই দুই কারণেই সোনার বাজারে ধস। জাপানের অর্থনীতি হঠাত্ খানিক ধাক্কা খাওয়ায় ইয়েনের সাপেক্ষে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াও একটি কারণ বটে।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, ধস এত দ্রুত নামল কী করে? এই এপ্রিলেই সোনার দাম করেছে সাড়ে তেরো শতাংশ। কেন এত দ্রুত দাম কমল, তার উত্তর রয়েছে কমোডিটি মার্কেটে, যেখানে বিভিন্ন পণ্য কেনা-বেচা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই লোকে ভবিষ্যতের সোনা কেনেন, পরিভাষায় যাকে বলে ফিউচার্স। তার জন্য পুরো দাম দিতে হয় না, মোটামুটি পাঁচ শতাংশ দিলেই চলে। অর্থাত্, সোনার দাম যখন গ্রামপিছু ৩২,০০ টাকা ছিল (মানে ৩২ লক্ষ টাকা কেজি), তখন ফিউচার্স মার্কেটে এক কেজি সোনা ধরতে হলে জমা করতে হত মাত্র এক লক্ষ ষাট হাজার টাকার মতো। এই টাকা বাজারে জমা থাকে। সোনার দাম পড়তে আরম্ভ করে একটা নির্দিষ্ট স্তরের নীচে চলে গেলে বাজার নিজে থেকেই চড়া দামে ধরে রাখা সোনার ফিউচার্স বেচে দেয়। তাতে বাজারে জোগান বাড়ে। ফলে দাম আরও কমে। ফলে বাজারে আরও সোনা বিক্রি হয়। এর নাম ‘সেল্ফ স্পিডিং স্পাইরাল’। এর ফলেই সোনার দাম ক’দিনেই এতখানি কমে গেল। |
|
শেষ পর্যন্ত। এপ্রিলের প্রথম পনেরো দিনে সোনার বাজারে দাম পড়ল সাড়ে তেরো শতাংশ। |
কিন্তু এগুলো সব আপাত-কারণ। ভারতের বাজারে সোনার দাম এতখানি বেড়েছিল কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই বোঝা যাবে, কেন সেই চড়া দাম ধরে রাখা অসম্ভব। বিশ্ব বাজারে সোনার দাম মার্কিন বাজারের দামে নির্ধারিত হয়। ১৯৮০ সালে মার্কিন বাজারে সোনার দাম ছিল প্রতি ট্রয় আউন্সে প্রায় ৬০০ ডলার। এখন, ১৭০০ ডলার। অর্থাত্, দাম বেড়েছে তিন গুণেরও কম। ভারতে ১৯৮০ সালে ১০ গ্রাম সোনার দাম ছিল ১৬০০ টাকা, ২০১২-র ডিসেম্বরে তা দাঁড়িয়েছিল ৩২,০০০ টাকা। কুড়ি গুণ মূল্যবৃদ্ধি। তিন দশকে মার্কিন বাজারে সোনার দাম বাড়ল তিন গুণ, ভারতের বাজারে কুড়ি গুণ। কেন এমন তারতম্য? সে হিসেব সোনার দামে নেই, আছে ডলারের সাপেক্ষে টাকার দামে। ১৯৮০’তে এক ডলারের দাম ছিল ৮ টাকা, এখন ৫৫ টাকার কাছাকাছি। অর্থাত্, টাকার সাপেক্ষে ডলারের দাম এই সময়ে সাত গুণ বেড়েছে। কাজেই, যাকে আমরা সোনার মূল্যবৃদ্ধি হিসেবে ধরে নিই, সেটা প্রধানত ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। এক অর্থে, সোনায় নয়, আমরা বিনিয়োগ করছি ডলারে।
আরও একটা কথা মনে রাখার। ১৯৮০-র পর থেকে মার্কিন বাজারে সোনার দাম ক্রমেই পড়তে থাকে। ১৯৯৬ সালে তা দাঁড়ায় ৩০০ ডলারেরও কম। বস্তুত, ২৬ বছর পরে, ২০০৬ সালে, সোনা ১৯৮০ সালের মূল্যস্তরে ফেরত যায়। আমরা টের পাইনি, কারণ ’৯১ সালে ভারতে আর্থিক সংস্কার শুরু হওয়ার পর, বস্তুত তারও আগে, ’৮৪ থেকে, ডলারের সাপেক্ষে টাকার দাম ক্রমেই কমতে থাকে। ফলে, সোনার দাম ভারতে কমেনি। তবে, ডলারের দামই সোনার দামকে ধরে রাখবে, এই ভরসায় থাকলে মুশকিল। তেমনটা হতে গেলে টাকার সাপেক্ষে ডলারের দাম যত বাড়তে হবে, তাতে ভারতীয় অর্থনীতিতে বিপুল ধাক্কা লাগবে। এতটাই যে, সোনায় বিনিয়োগ করার মতো টাকাই আমার-আপনার হাতে থাকবে না।
দামের বুদ্বুদ তৈরি হচ্ছে কি না, বোঝা কঠিন। তবে যে কোনও বুদ্বুদেরই কিছু চরিত্রলক্ষণ থাকে। দাম হঠাত্ আকাশ ফুঁড়ে উঠতে থাকে, আর বেশ কিছু দিন সেই চড়া স্তরেই থেকে যায়। এটাই কিন্তু সাবধান হওয়ার সময়। ঠিক এই সময়েই এমন অনেক লোক বিনিয়োগের বাজারে ঢুকে পড়েন, যাঁরা আগে কখনও বিনিয়োগ নিয়ে মাথা ঘামাননি। যখন কোনও সম্পদের দামের বুদ্বুদ তৈরি হয়, লোকের খাবার টেবিলেও ঢুকে পড়ে সেই সম্পদে বিনিয়োগের প্রসঙ্গ। আসলে, প্রত্যেকেই চান চড়া বাজারে কিছু লাভ করে নিতে। কিন্তু সে লাভ তো খাতায় কলমে। সবাই সম্পদ ধরে রাখেন, আরও দাম বাড়ার প্রতীক্ষায়। যাঁরা এই লেখা পড়ছেন, তাঁদের মধ্যে কত জন ৩২,০০০ টাকায় সোনা বেচেছিলেন?
যখন প্রথম-বার-বিনিয়োগকারীরা বিপুল সংখ্যায় কোনও একটি বাজারে ঢুকতে থাকেন, তখনই দাম সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছয়। আর তখনই বুদ্বুদ ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কারণ, যাঁরা নতুন ঢুকছেন, তাঁরা আগের লোকরা কী করেছে, সেটা দেখে নিজেদের স্ট্র্যাটেজি ঠিক করেন দ্রুত লাভের জন্য ফাটকার সিদ্ধান্ত করেন। সবাই নিজেদের, এবং অপরকে, বোঝাতে চেষ্টা করেন যে আসলে বুদ্বুদ নয়, অর্থনৈতিক কারণেই দাম বাড়ছে। এটাই বুদ্বুদের সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা।
১৯৮০ সালেও সোনার দামের একটা বুদ্বুদ (গোল্ড ম্যানিয়া অব এইটটি) চরমে পৌঁছেছিল। ১৯৭১-এ যেখানে এক ট্রয় আউন্স সোনার দাম ছিল ৩৫ ডলার, ১৯৮০’র জানুয়ারিতে তা ৮৫০ ডলারে পৌঁছয়। তার নানা কারণ ছিল: মূল্যস্ফীতির হার দশের ঘরে, ইরানে ইসলামি বিপ্লব, আফগানিস্তানে সোভিয়েত অভিযান। এই ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা থিতিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সোনার দাম কমতে আরম্ভ করে ১৯৯৯ সালে তা ২৫০ ডলারে ঠেকে। কাজেই, বুদ্বুদ হইতে সাবধান।
বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের ‘বেস ইয়ার’ হল ১৯৮০। অর্থাত্, ১৯৮০ সালে সেনসেক্স-এর মান ছিল ১০০। আজ, কম-বেশি ১৯,০০০। অর্থাত্, ১৯৮০ সালে সমপরিমাণ টাকা সোনা আর শেয়ারে বিনিয়োগ করলে আপনার সোনার টাকা এত দিনে বাড়ত ২০ গুণ, আর শেয়ারের টাকা ১৯০ গুণ! সোনায় বিনিয়োগ যতটা আকর্ষণীয় লাগে, আসলে ততটা নয়।
|
ডিরেক্টর, অ্যালগো অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি ডেভেলপমেন্ট, প্রফিশিয়েন্ট ইনফোসফ্ট প্রাইভেট লিমিটেড |
|
|
|
|
|