পয়লা বৈশাখ পেরিয়েও বৌবাজারে এখন চৈত্র সেলের মেজাজ। সৌজন্যে ‘জলের দরে’ সোনা।
ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যেতে যেতে একেবারে হঠাৎই যেন কিছুটা নাগালে এসে গিয়েছে সোনা। কিছু দিন আগেও যার দাম বাড়ছিল রকেট গতিতে, আচমকা তার দরে ভাটা। আর সেই পড়ে পাওয়া সুযোগ কাজে লাগাতেই বৌবাজারের গয়না পাড়ায় এখন চৈত্র সেলের ভিড়।
সামনেই বিয়ের মরসুম। তাই বিয়ের দিনক্ষণ পাকা হয়ে যাওয়া মেয়ের বাড়ির লোকজন পড়িমড়ি তো আসছেনই। দোকানের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ছেন এমন অনেকেও, যাঁদের এখনই হয়তো গয়না কেনার তত প্রয়োজন ছিল না। শুধু কম দামের সুযোগ হাতছাড়া না-করার ‘পণ নিয়ে’ই গয়না কিনতে আসছেন তাঁরা। অনেকটা বছর শেষের সেলের সময় বাজার করার মতো।
আর হবে না-ই বা কেন? গত নভেম্বরেও ১০ গ্রাম পাকা সোনার (২৪ ক্যারাট) দাম উঠে গিয়েছিল ৩৩ হাজার টাকায়। সেখান থেকে এখন তা নেমে হয়েছে ২৬,৮০০। গয়নার সোনাও (২২ ক্যারাট) ৩১,৩১০ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২৫,৪২৫ টাকায়। কলকাতায় হপ্তা খানেকেই প্রতি ১০ গ্রাম গয়নার সোনার দাম কমেছে প্রায় তিন হাজার টাকা।
অনেক গয়না ব্যবসায়ীই জানাচ্ছেন, চড়চড়িয়ে দাম বাড়ার পর ৩ থেকে ৫ শতাংশ দাম কমতে তাঁরা আগেও দেখেছেন। কিন্তু তা বলে এ ভাবে ধস নামতে কখনও দেখেননি। তা ছাড়া, সোনার দামের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হিসেবেই গয়নার মজুরি ধার্য হয়। তাই ওই দর নামার সঙ্গে সঙ্গে কমেছে মজুরির অঙ্কও। ফলে চোখে পড়ার মতো ভিড় হচ্ছে সোনার দোকানে। বিয়ে ছাড়াও স্রেফ কম দামের সুযোগ ঘরে তুলতেই সোনার দোকানে চলে আসছেন অনেকে।
যেমন, আন্দুল রোড থেকে গয়না কিনতে এসেছিলেন দেবাশিস দাস। তিনি জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে তাঁর পরিবারে কোনও অনুষ্ঠান নেই। তাঁকে টেনে এনেছে দাম কমার চুম্বকই।
দক্ষিণ কলকাতার সুপ্রতিম দত্ত আবার চান এই সুযোগে মায়ের ‘ঋণ শোধ’ করে দিতে। বাড়ি করার সময় মায়ের গয়না বিক্রি করতে হয়েছিল তাঁকে। এখন নতুন গয়না আবার মায়ের হাতে তুলে দিতে চান তিনি।
কিন্তু দাম যদি আরও পড়ে? সেই ভরসায় আর দেরি করতে চাইছেন না অধিকাংশ ক্রেতাই। বরং তাঁদের ভয়, যদি উল্টোটা হয়? যেমন দেবাশিসবাবুই জানাচ্ছেন, “কে বলতে পারে খুব তাড়াতাড়িই দাম ফের বাড়বে না?” একই মত বি টি রোডের সুজাতা দাসের। পর পর দু’দিন গয়না কিনতে আসা সুজাতাদেবী বলছেন, “সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না। পরে দাম বাড়লে আফশোস হবে।”
বস্তুত সোনার দাম কি আরও কমবে? কমলেও তা কতটা? না কি ফের উঠতে শুরু করবে সোনার দর? এই মুহূর্তে বাজারে লাখ টাকার প্রশ্ন সম্ভবত সেটাই।
কিন্তু এ নিয়ে একেবারে নিশ্চিত উত্তর দিতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরাও। অল ইন্ডিয়া জেম অ্যান্ড জুয়েলারি ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান বাছরাজ বামালুয়ার মতে, “দাম আরও কমবে কি না, বলা মুশকিল। আমার ধারণা, তা ২৬-২৭ হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করবে।” একই কথা মনে করছেন স্বর্ণ শিল্প বাঁচাও কমিটির কার্যকরী সভাপতি বাবলু দে। তাঁরা মনে করছেন, দাম কমায় সোনার চাহিদা চড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। ফলে দর ফের কিছুটা উঠবে।
বুধবারের তুলনায় বৃহস্পতিবার সোনার দর কিছুটা বেড়েওছে। তবে তা সামান্য। পাকা সোনায় প্রতি ১০ গ্রামে ৯০ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারেও বুধবার কিছুটা বেড়েছে সোনা।
বাড়তি চাহিদার হাত ধরে দাম বৃদ্ধির তত্ত্ব যেমন রয়েছে, তেমনই সোনার দর আরও পড়ার সম্ভাবনাও বজায় রয়েছে পুরোদস্তর। যেমন, বামালুয়াই মনে করছেন, “গয়না কেনার প্রবণতা বাড়ছে ঠিকই। কিন্তু লগ্নি হিসেবে সোনায় টাকা ঢালার আগ্রহে ভাটা পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে দাম আরও কমার সম্ভাবনা।”
তা ছাড়া, ভারতে সোনার দামের ওঠা-পড়া প্রধানত নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারের গতিবিধির উপর। সম্প্রতি সেখানে সোনার দর কিছুটা চড়লেও এখনও পর্যন্ত অবস্থা মোটেও সুবিধার নয়। কারণ, আর্থিক হাল ফেরাতে সোনা বিক্রির কথা ভাবছে সাইপ্রাস। একই ইঙ্গিত দিয়েছে ইতালি এবং পর্তুগালও। বাজারের আশঙ্কা, এই দৃষ্টান্ত এক বার তৈরি হলে, আগামী দিনে ওই একই পথে হাঁটতে পারে ইউরোপের আরও বেশ কয়েকটি দেশ। সে ক্ষেত্রে বিশ্ব বাজারে সোনার জোগান হঠাৎই বেশ বেড়ে যেতে পারে। ফলে আরও কমতে পারে দাম। এমসিএক্স-এসএক্সের পূর্বাঞ্চলীয় কর্তা অরিন্দম সাহা জানাচ্ছেন, “সর্বোচ্চ অঙ্কের থেকে দাম ৫০% নামার নজিরও রয়েছে।” |