পর পর দু’দিন, তিন-তিনটে ঘটনায় সন্ত্রস্ত ওবামার দেশ, বিপর্যস্ত অসংখ্য মানুষ। মঙ্গলবার বস্টন ম্যারাথনে জঙ্গি হানা, আর পরের দিনই ওবামার উদ্দেশে বিষ মাখানো চিঠি। দিন ফুরলো না, এ বার বিস্ফোরণ টেক্সাসের সার কারখানায়। সকালের দিকে স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলো বলছিল মৃত অন্তত ৭০। পরে অবশ্য শোনা যায়, ১৫ থেকে ২০ জন মারা গিয়েছেন। তবে মুখে কুলুপ প্রশাসনের। তারা বলছে, সঠিক সংখ্যা জানা নেই। আর আহত কয়েকশো। যদিও এ ঘটনায় এখনই সন্ত্রাসের ছায়া দেখছে না সরকার।
টেক্সাসের ওয়াকোর কাছে ‘ওয়েস্ট’। ছোট শহরটায় ২৮০০ লোকের বাস। বুধবার সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ বিস্ফোরণ ঘটল সার কারখানায়। আর নিমেষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল আশপাশের গোটা অঞ্চল। কারখানা থেকে বেরনো ধোঁয়ার কুণ্ডলী মুহূর্তে মনে করিয়ে দিয়েছে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ। ফিরছে চের্নোবিল-আতঙ্ক। পরিণতি দেখে কেউ কেউ বলছে, ‘যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক’। কারখানা লাগোয়া চার-চারটে ব্লক নিশ্চিহ্ন। ৬০-৭০টি বাড়ির ধ্বংসস্তূপ ঘেঁটে বের করা হচ্ছে আহতদের, কখনও মিলছে নিথর দেহ। হাসপাতালে ভর্তি করার বদলে সেখান থেকেই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রোগীদের। এক এক করে প্রত্যেকটা বাড়িতে গিয়ে খোঁজ করছেন উদ্ধারকারী কর্মীদের দল। মাথা গোনা হচ্ছে প্রত্যেকের, যেন কেউ বাদ না যায়। সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আশ্রয় শিবিরে। ফের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে, আতঙ্কিত প্রশাসন তাই বাড়িতে রাখতে চাইছে না কাউকে। |
বিস্ফোরণের প্রভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে টেক্সাসের সার কারখানা সংলগ্ন অ্যাপার্টমেন্টটি। ছবি: এপি |
বলা হচ্ছে যে যেখানেই থাকুন না কেন, জানলা-দরজা শক্ত করে বন্ধ করে রাখুন, বাইরের বিষাক্ত হাওয়া যেন ভিতরে না ঢোকে। বাতাসে যে মারণ-গ্যাস অ্যামোনিয়া। এ সবের মধ্যেই আবার বিদ্যুৎ নেই, অন্ধকারে ডুবেছে গোটা এলাকা। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, ওয়েস্টের দিকে আসা গাড়িগুলোকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। টেক্সাসের উপর দিয়ে যেন বিমান না যায়, সে বিষয়ে হুঁশিয়ার করা হয়েছে বিমান মন্ত্রককে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন, “জানলাটা ভেঙে একটা দমকা হাওয়া ভিতরে ঢুকে এল। ঘরের ছাদ ভেঙে পড়ল মাথার উপর। কোনও মতে বেরিয়ে এলাম ধ্বংসস্তূপের তলা থেকে। বাড়িঘর ভেঙে পড়ে রাস্তাটাও হারিয়ে গিয়েছে কোথায়।” সামনের অ্যাম্বুল্যান্স স্টেশনে ছিলেন ওঁর ছেলে। বললেন, “ওই বাড়িটার দু’তলায় ছিল ও। নিশ্চই ধ্বংসস্তূপে আটকে রয়েছে।” এর মধ্যেই ইউ টিউবে এসেছে বিস্ফোরণের একটা ভিডিও। মালিকের নাম জানা যায়নি। তবে বোঝা যাচ্ছে, কারখানায় আগুন লেগেছে দেখে গাড়ি থামিয়ে ভিডিও করেন লোকটি। সঙ্গে তাঁর বাচ্চা ছেলেটিও ছিল। কিছু ক্ষণ পরেই একটা বীভৎস বিস্ফোরণের আওয়াজ। কেঁপে উঠল গাড়ি। বাচ্চাটি প্রাণপণ চিৎকার করতে শুরু করল, “বাবা, দয়া করে এখান থেকে নিয়ে চলো।”
|
ওয়েস্টের সার কারখানা থেকে ক্রমাগত বেরোচ্ছে অ্যামেনিয়া গ্যাস। আগুন অবশ্য নিয়ন্ত্রণে এসেছে। দমকল কর্মীরা সতর্ক করে দিয়েছেন, এখনও একটা অ্যামোনিয়া ট্যাঙ্ক অক্ষত রয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে সেটাতেও। বাতাসে মিশে থাকা ঝাঁঝালো অ্যামোনিয়ায় ইতিমধ্যে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে অনেকের। এ তো গেল প্রাথমিক সমস্যা, এর সঙ্গে অ্যামেনিয়া শরীরে ঢুকে জলের সঙ্গে মিশলে ভিতর পুড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ঘনত্ব বেশি হলে মৃত্যু অবধারিত। সে সব কিছু না হলেও অন্তত চোখমুখে, শ্বাসনালীতে, গায়ের চামড়ায় জ্বালা ভাব, শ্বাসকষ্ট অবশ্যম্ভাবী। এর মধ্যেই মুখোশ পরে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ-প্রশাসন। দমকলকর্মীদের ৬ জনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়র টমি মুস্কা বলেন, “আপনারা প্রার্থনা করুন। প্রচুর লোক এখানে আহত অবস্থায় রয়েছেন, কাল সংখ্যাটা আরও বাড়বে। আমরা শুধু প্রত্যেকের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছি। মাথা গোনা হচ্ছে। সবাই ঠিক আছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। ওটাই এখন সব চেয়ে দরকারি।” মুস্কার কথা কতটা সত্যি বোঝা যাচ্ছে হাসপাতালের অবস্থা দেখে। বিস্ফোরণের কিছু ক্ষণের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন অন্তত ৬০ জন। কারও হাত-পা ভেঙে গিয়েছে, বিস্ফোরণের জেরে ফেটে গিয়েছে ফুসফুস, কানের পর্দা ছিড়ে গিয়েছে কারও, শরীর থেকে বেরিয়ে এসেছে অন্ত্রনালী। কেউ আবার পুড়ে গিয়েছেন বিস্ফোরণের আগুনে। আহতদের মধ্যে রয়েছেন উদ্ধারকর্মীরাও। তবে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা যাচ্ছে না রোগীদের। বরং সেখান থেকেই ১৩৩ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দূরের নার্সিং হোমে। আর ওয়েস্টের ফুটবল মাঠটা হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ইউনিটের চেহারা নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, “একটা সুন্দর জোটবদ্ধ সমাজকে নাড়িয়ে দিল ঘটনাটা। কিছু ভাল, পরিশ্রমী মানুষ প্রাণ হারালেন। যাঁরা দিনরাত এক করে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের অসংখ্য ধন্যবাদ।”
যে চিন্তা সব চেয়ে বেশি কপালে ভাঁজ ফেলেছে ওবামা-প্রশাসনের, তা হল বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাব কোন পর্যায়ে পৌঁছবে। বিস্ফোরণের পর আকাশে ছড়িয়ে পড়া বিষাক্ত গ্যাসের কুণ্ডলী শেষ করে দিতে পারে গোটা শহরটাকেই। সেই আতঙ্কে অর্ধেক শহর উঠেছে আশ্রয় শিবিরে। গোদের উপর বিষফোড়া, ঝড়ের পূর্বাভাস। তার জেরে আরও বড়সড় চেহারা নিতে পারে বিপর্যয়। এখন দক্ষিণের দিকে হাওয়া বইছে। যদি ঝড় না-ও হয়, হাওয়ার মুখও ঘুরে গেলেই আধপোড়া শহরটার বাকিটাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। |