|
|
|
|
শঙ্কুর নতুন চশমা |
গুগল গ্লাস তখন থাকলে আর ফেলুদাকে লাগত না। শঙ্কুই গোয়েন্দাগিরি করতেন। লিখছেন কল্যাণ কর |
বহু বছর আগে এক বার কেদারনাথ বেড়াতে গিয়েছিলাম। পথে এক সাধুবাবার সঙ্গে দেখা। এখনও মনে আছে, সেই সাধুবাবা সানগ্লাস পরে ছিলেন। আমাদের সামনে সাধুবাবা আমাদের সবার নাম বলে চমকে দিয়েছিলেন। হারুকে বলেছিলেন, “তুই অনেক লোককে খাওয়াবি।!”হারু আজ ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা করে। সঞ্জয়কে বলেছিলেন, ‘তোর জন্য বহু লোকের জীবন পাল্টে যাবে”...সঞ্জয়ের শেয়ার মার্কেটের টিপস পেয়ে আজ বহু লোক সর্বস্বান্ত! এই রকম সব অসাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পরে আমরা সাধুবাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম“সাধুবাবা, আপনি কী করে সব বলতে পারেন? আমাদের নাম, কবে কী করব, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ?” সাধুবাবা মৃদু হেসে
|
গুগল গ্লাস চোখে গুগল-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা সার্গেই ব্রিন |
বলেছিলেন, “ এই চশমা পরে আমি দুনিয়া দেখতে পাই রে পাগল। তোরাও হিমালয়ে এসে ধ্যান কর, তোরাও পারবি।” আমাদের অবশ্য হিমালয়ে গিয়ে ধ্যান করা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আমাদের প্রার্থনা তথ্যপ্রযুক্তি দেবতা নিশ্চয়ই শুনেছিলেন!
বহু বছর পরে, তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াতে অবস্থিত আড়াই লক্ষ কোটি টাকার কোম্পানি গুগল এক অতি আশ্চর্য বস্তু বাজারে ছাড়ার জন্য তৈরি হয়েছে। যার নাম ‘গুগল গ্লাস’। আপাতত পরীক্ষা চলছে। এবং আর কয়েক মাসের মধ্যেই তা জনসাধারণের জন্য বাজারে ছাড়া হবে। গুগল কোম্পানি সম্বন্ধে জানেন তো? যারা ‘খোঁজ’-এর মানেই পাল্টে দিয়েছে। ইন্টারনেট সার্চ
ইঞ্জিন গুগল দিয়ে আপনি যে কোনও বিষয়, যে কোনও সময় জেনে নিতে পারবেন। গুগল এতটাই জনপ্রিয় যে আগে আমরা বলতাম, নো প্রবলেম, খুঁজে নেব। এখন বলি নো প্রবলেম ‘গুগল’ করে নেব। সম্প্রতি আমির খান তাঁর তালাশ সিনেমা জনপ্রিয় করার জন্য গুগলের সাহায্য নিয়েছেন। কারণটা কী বুঝছেন? ‘গুগল’ মানেই তো এখন ‘তালাশ’। বুদ্ধিমান আমির জেনারেশন ‘ওয়াই’-এর কাছে পৌঁছতে এর থেকে ভাল মাধ্যম যে আর পেতেন না, তা তিনি জানতেন।
তা এই গুগল কোম্পানি বাজারে যাই ছাড়ে, তাই নিয়েই মানুষের মধ্যে খুব কৌতূহল শুরু হয়। আপনাদের চুপি চুপি বলে রাখি গুগল কোম্পানি বাজারে খুব শীঘ্র ড্রাইভারবিহীন গাড়ি ছাড়বে। হ্যাঁ, ঠিক পড়েছেন, সেই গাড়িতে কোনও ড্রাইভার থাকবে না। লঞ্চ করার পরে সেই গাড়ি আমাদের ধর্মতলায় কী রকম চলে তা জানার জন্য অপেক্ষায় রইলাম। তবে সেই গল্প অন্য দিনের জন্য তোলা রইল। আজ শুধুই ‘গুগল গ্লাস।’
কী এই গুগল গ্লাস? কেন এটা নিয়ে এত কৌতূহল মানুষের? আসলে গুগল গ্লাস হল সেই সাধুবাবার দিব্যদৃষ্টি চশমা। চমকে যাচ্ছেন?
|
|
তা হলে শুনুন...
জিনিসটা একটা খালি চশমার ফ্রেমের মতো দেখতে। যেটায় কোনও কাচ নেই। শুধু ফ্রেমটা আছে। আর আছে একটি ছোট যন্ত্র। ডান চোখের ফ্রেমে লাগানো। দেখতে অনেকটা কাচের একটা টুকরোর মতো। যেটা আসলে একটা স্ক্রিন। কিন্তু সেই যন্ত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। তাতে স্টিল ছবি তোলা যায়। ফোন করা যায় এবং এই সব আপনি করতে পারবেন ভয়েস কম্যান্ড দিয়ে। অর্থাৎ আপনার হাত দিতে হবে না। শুধু হুকুম করবেন আর হয়ে যাবে।
কী রকম?
ধরুন পথ চলতে গিয়ে একটা দারুণ দৃশ্য দেখলেন। আপনি শুধু বলবেন, “ওকে গ্লাস, রেকর্ড এ ভিডিও”। ব্যস, রেকর্ড হয়ে যাবে। বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন...রাস্তা হারিয়ে গিয়েছে? “ওকে গ্লাস, গিভ ডিরেকশন টু...” ব্যস, দিকনির্দেশ পেয়ে গেলেন। সার্চ করা, মেসেজ করা, আবহাওয়া জানা, ডিরেকশন জানা, ট্রেন বা প্লেনের টাইম, কখন কোথায় মিটিং, ছবি তোলা, ভিডিও তোলা, ফোন করা, মায় অন্য ভাষায় অনুবাদ পর্যন্ত করতে পারবেন। ভাবা যায়!
ভেবে দেখুন ওই ছোট্ট চৌকো কাচের মধ্যে কী শক্তি লুকিয়ে আছে! যা শুধু আপনার হুকুম শুনলেই মুহূর্তের মধ্যে কাজ হাসিল করে দেবে। সোজা কথায় একটা স্মার্টফোন। সঙ্গে ভিডিয়ো আর স্টিল ক্যামেরা লুকিয়ে আছে এই ‘গুগল গ্লাস’-এ। যা ছোঁয়ার দরকার হয় না। অনেক ক্ষেত্রে স্ক্রিনের ওপরে যখন মাল্টিপল চয়েজ ফুটে উঠবে, তখনও আপনাকে হাত লাগাতে হবে না। মাথা হেলিয়ে বা ঘুরিয়ে আপনি আপনার চয়েজ বাছতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন ফ্রেমের সাইডে টাচ করেও আপনি সিলেক্ট করতে পারেন। যদি আপনি তা চান। অর্থাৎ ‘টাচ’ এবং ‘মোশন সিলেক্ট’ দুটোই দেওয়া আছে।
এই বারে আর এক ধাপ এগিয়ে যাই। |
|
গুগল গ্লাস জিনিসটা ফ্যাসিনেটিং। আমার নতুন টেকনোলজির প্রতি আকর্ষণ আছে, তাই গুগল গ্লাস নিয়ে পড়াশোনা করছি। মনে হচ্ছে শঙ্কুর গল্প নতুন করে লিখতে হবে। এ রকম গ্লাস যদি ফেলুদা পেত তাহলে তো আর বিভিন্ন জায়গায় যেতেই হত না। টেকনোলজি যে ভাবে এগোচ্ছে, আর কিছু দিন পরে হয়তো ‘হুডানইট’ বলে একটা সফটওয়্যার বেরিয়ে যাবে। সব ঘটনা বলে, মানুষগুলোর নাম ফিড করে দিলে, কে দোষী বা খুনি বেরিয়ে আসবে।
সন্দীপ রায় (পরিচালক) |
|
এটা এমন যন্ত্র যা কল্পবিজ্ঞানকে বাস্তবে পরিণত করেছে। যাকে আমরা ভাবতাম নিখাদ সায়েন্স ফিকশন তাই এখন হাতের সামনে। আমার মতো একজন লোক যে মিডিয়া আর তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত কোম্পানি চালায় তার কাছে গুগল গ্লাসের সব চেয়ে স্টাইলিশ দিক হল এমন সব অ্যাঙ্গেল থেকে ভিডিয়ো তুলতে পারা যা আগে সম্ভব ছিল না। আর সেগুলো ‘লাইভ’ দেখানোর অসামান্য সুযোগ।
অনি শীল (কর্ণধার, ডেটা বাজার মিডিয়া, মায়ামি) |
|
যন্ত্রটা যে যুগান্তকারী হতে যাচ্ছে বুঝতেই পারছি। কিন্তু যদি সবার হাতে চলে যায়, তাহলে আর গোয়েন্দারা আলাদা সুবিধে পাবে কী করে? পুলিশের লোক হিসাবে আমি সব সময় এমন যন্ত্র চাইব যা অপরাধীদের হাতে থাকবে না, শুধু আমাদের হাতে থাকবে। যেমন পুলিশের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকে। সাধারণ মানুষের হাতে থাকে না। যেমন একটা সময়ে ওয়্যারলেস সার্ভিসে খবর দেওয়া যেত। ল্যান্ড ফোন ছাড়া তখন কিছু ছিল না। পুলিশের একটা ‘এজ’ ছিল। আজ মোবাইলের যুগে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আমি আশা করব ভবিষ্যতে, গুগল গ্লাসের এমন উন্নত একটা মডেল গোয়েন্দারা সঙ্গে রাখার সুযোগ পাবে, যেটা জনগণের জন্য নয়।
সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ
(নগরপাল) |
|
|
ধরুন আপনি সামনে কাউকে দেখতে পেলেন...রিসার্চ চলছে যার ফোনে, আপনি একটা হুকুম দিলেই তার ছবি মিলিয়ে আপনার গুগল গ্লাস ঠিকুজিকুষ্ঠি আপনাকে জানিয়ে দেবে। চোখের ওপরে ওই কাচের স্ক্রিন-প্লেটটায় হাঁড়ির সব খবর ফুটে উঠবে। কী দারুণ ব্যাপার না? দাঁড়ান এর একটা বিরাট সমস্যাও আছে। ভাবুন তো আপনি সামনে বসা এক সুন্দরী মহিলাকে খুব ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ সে আপনার সামনে এসে বললে, “হ্যালো মিস্টার, ভাল আছেন তো? আচ্ছা আপনি মাধ্যমিকে ফেল করলেন কেন বলুন তো? অঙ্কে আপনি বরাবরই কাঁচা, কিন্তু তাই বলে টুকতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলেন? আর গতকাল তো আপনার বস আপনাকে সবার সামনে অপমান করলেন। আপনি টার্গেট মিট করতে পারেননি বলে...কোথায় আপনি কাজে মন দেবেন, তা নয় তখন থেকে দেখে যাচ্ছি আপনি আমাকে নিয়ে সার্চ করছেন আমার ইনফরমেশন জানার জন্য!” চমকে গিয়ে আপনি হঠাৎ দেখতে পেলেন যে এই সুন্দরীও একটি ‘গুগল গ্লাস’ পরে বসে আছেন। এবং আপনার ঠিকুজিকুষ্ঠি জেনে নিয়েছেন! হ্যাঁ, এটা সম্ভব এবং সেখানেই গণ্ডগোল। ইতিমধ্যে ‘গুগল গ্লাস’য়ের ‘প্রিভেসি’র ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। কোনও আবিষ্কার যদি আপনার ব্যক্তিগত জীবনকে যে কোনও অচেনা মানুষের সামনে খোলা বইয়ের মতো তুলে ধরে, তা হলে তো সমস্যা বৈকী!
‘গুগল গ্লাস’য়ের ভিডিয়ো রেকর্ডিং এমন সূক্ষ্ম অবস্থায় চলে যে কেউ চট করে ধরতেও পারে না। এর ফলেই ব্যক্তিগত জীবনে যেমন সমস্যা হতে পারে, এর ভাল দিকও আছে।
আপনার অজান্তেই হয়তো আপনার সামনে বসা লোকটি আপনার ছবি বা ভিডিও তুলে নিল, আপনি জানতেও পারলেন না। কিন্তু এটাও ভেবে দেখুন, এর ফলে ‘স্টিং অপারেশন’ কত স্মার্ট হয়ে যাবে। কেউ ঘুষ নিচ্ছে, ধরা পড়ে যাবে। কেউ পরীক্ষায় টুকছে ধরা পড়ে যাবে। রাস্তায় কোনও ঝামেলা হল, প্রত্যক্ষদর্শী তা রেকর্ড করে নেবেন। এক কথায়, ভাল খারাপ দুই দিকের কার্যকারিতা মিলিয়েই দারুণ একটা ব্যাপার! |
মহিমা |
• চশমার মতোই চোখে পরা যায় এমন একটা কম্পিউটার গুগল গ্লাস
• গুগল কোম্পানি তাদের এই গ্লাসকে পেটেন্ট করে নিয়েছে
• ট্যাঞ্জারিন, চারকোল, শেল, কটন এবং স্কাইব্লু রঙে পাওয়া যাবে গুগল গ্লাস
• গুগল-এর সব অ্যাপ্লিকেশনই পাওয়া যাবে গুগল গ্লাসে। তাই গুগল নাউ, গুগল ম্যাপ, গুগল প্লাস আর জি-মেল করতে ট্যাব, আইপ্যাড লাগবে না আর
• গুগল গ্লাস এক্সপ্লোরার এডিশন এখন আমেরিকায় পাওয়া যাচ্ছে। তবে তা শুধু রিসার্চার বা টেস্টারদের জন্য। কনজিউমার এডিশনটা পাওয়া যাবে বছর শেষের আগেই
৭৫০০০ টাকাতেই সবজান্তা এই চশমা চোখবন্দি হতে পারে আপনার। শোনা যাচ্ছে বাজারে এলে দাম কমতেও পারে
•আপনার ব্যক্তিগত সব তথ্য এই গ্লাসের দাক্ষিণ্যে অন্যের মুঠোবন্দি হতে পারে, চিন্তাটা কপালে ভাঁজ ফেলেছে আগেই। গাড়ি চালানোর সময় এই গ্লাস কতটা নিরাপদ, সেই প্রশ্নটাও বাদ যাচ্ছে না
• গুগল-এর নিজস্ব রিটেল স্টোর্সে ক্রেতারা নিজেরাই এই গ্লাস যাচাই করে নিতে পারবেন |
|
তবে মনে রাখবেন এই আশ্চর্য আবিষ্কার এখনও বাজারে ছাড়া হয়নি। খুব তাড়াতাড়ি ছাড়া হবে। এখনও যারা চশমা পরেন তাঁদের জন্য রিভাইসড মডেল তৈরি হয়নি। তবে গুগল কোম্পানি আশ্বস্ত করে বলেছে, যাঁরা চশমা পরেন তাঁদের জন্যও ‘গুগল গ্লাস’ তৈরি হবে। আপনার চশমার কাচের ওপর দিব্যি বসে যাবে এই ‘গুগল গ্লাস’ খুব তাড়াতাড়ি। এর পরে চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে আপনার চশমার সঙ্গে ‘গুগল গ্লাস’কে এঁটে দেওয়া যায়। অর্থাৎ আপনি যে চশমাটা পরবেন তাতেই ‘গুগল গ্লাস’ জুড়ে দেওয়া হবে। আপনাকে আলাদা করে আর পরতে হবে না। আপাতত এর দাম ধার্য হয়েছে পঁচাত্তর হাজার টাকার কাছাকাছি। কিন্তু অনেকের ধারণা, যখন বাজারে ছাড়া হবে তখন এর দাম অনেকটাই কম হবে।
যাই হোক, পরিশেষে বলে রাখি, খুব শীঘ্রই আপনার আশপাশে চোখের ওপর ঠুলি পরা প্রচুর লোক দেখতে পাবেন। ভাববেন না যেন এঁদের চোখে কোনও অসুখ করেছে। আসলে এঁরা ‘গুগল গ্লাস’ লাগিয়ে রেখেছেন। সব সময় সজাগ থাকবেন, কারণ কে কখন কী রেকর্ড করল তা তো আপনি জানতেই পারবেন না। এই ধরুন বাস থেকে নেমে রাস্তার ধারে সামনের দেওয়ালে অন্যায় কাজটি শুরু করেছেন, হঠাৎ পিছন থেকে শুনলেন ‘ওকে গ্লাস রেকর্ড আ ভিডিয়ো।’ সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালান। কারণ না হলে আপনার কৃতকর্ম ভিডিয়ো রেকর্ড হয়ে এক মিনিটের মধ্যে ইউ টিউবের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। এবং আপনার জীবনে যারপরনাই অশান্তি ডেকে আনবে।
জয় ‘গুগল গ্লাস’! জয় কলিযুগ!
সাধুবাবাদের চাকরি গেল বলে!
|
|
(লেখক: আইটি বিশেষজ্ঞ)
সূত্র: গুগল |
|
|
|
|
|