|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
ছাত্র রাজনীতির আদর্শ আর বাস্তব |
কলেজে কলেজে সুপরিবর্তন আনা যায়, যদি অধ্যক্ষ-অধ্যাপক মিলে তাঁদের স্বশাসনের অধিকার এবং
ছাত্রদের
অধিকার রক্ষার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেন। এর জন্য দলীয় সম্মতি বা সরকারি
আদেশের
প্রয়োজন হয় না।
দরকার শুধু প্রতিষ্ঠানের প্রতি মমতা আর ছাত্রছাত্রীর ওপর আস্থা।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় |
ছাত্র রাজনীতি প্রসঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে সুকান্ত চৌধুরী যা লিখেছেন (‘নীতি রাজনীতি ছাত্রনীতি’, ১৪-৪), তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘকাল ধরে কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সূত্রে ছাত্র রাজনীতির নোংরামি আর হিংসার বহু কলঙ্কময় ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতালব্ধ মতামতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে দু’টি বিষয়ে আমার দ্বিমত প্রকাশ করতে চাই।
প্রথমত, চার পাশের জগৎ সম্বন্ধে স্বাধীন চেতনা লাভ, সমাজবোধের উন্মেষ, প্রতিবাদের প্রত্যয় ইত্যাদি যে-সব লক্ষণ ছাত্র বয়সে দেখা দেয়, তার সূত্র ধরে ছাত্রদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার যে-প্রক্রিয়া সুকান্ত বর্ণনা করেছেন, তার মানে দাঁড়ায় এই যে, ছাত্রছাত্রীদের অপরিণত আবেগপ্রবণতার বশে তারা বয়স্ক রাজনৈতিক নেতাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়। তারা নিজেরাই বোঝে না যে অন্যেরা তাদের ব্যবহার করছে। প্রশ্ন হল, এই ব্যাধির কবলে শুধু ছাত্ররাই পড়ে কেন? আঠারোর পরে সকলেই তো ভোটের অধিকারপ্রাপ্ত নাগরিক। তা হলে যে কোটি কোটি তরুণ ভারতবাসীর কলেজের চৌকাঠ পেরনোর সৌভাগ্য হয় না, তারা কি রাজনীতিতে জড়ায় না, দলে যোগ দেয় না? দিলে, তারা কি দলের নেতাদের হাতে পুতুল বনে যায়? না কি, তেমন হলেও বিশেষ কিছু এসে যায় না, কারণ তারা তো আর আমাদের মতো শিক্ষিত ঘরের ছেলেমেয়ে নয়। সুকান্ত কথাটা পুরোপুরি ভেবে বলেছেন কি না জানি না, কিন্তু ছাত্র রাজনীতিতে দলীয় নেতাদের আধিপত্যের বিষময় পরিণতি নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তা তরুণ শ্রমিক, কৃষক, বেকার, সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়ার কথা। সে ক্ষেত্রে সমস্যা শুধু ছাত্র রাজনীতি নিয়ে নয়, তরুণবয়স্ক সকলের বেলাতেই একই সমস্যা রয়েছে বলে ধরে নিতে হয়। তা হলে সুকান্তর কথা থেকে একটাই সিদ্ধান্ত অবধারিত হয়ে পড়ে। ভোটাধিকার পাওয়ার বয়স আঠারোতে নামিয়ে আনাটা মারাত্মক ভুল হয়েছিল, ওটা বাড়িয়ে একুশ বা পঁচিশ করে দেওয়া উচিত। |
|
চেতনার পাঠ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, মার্চ ২০১৩। ছবি: অমিত দত্ত |
সুকান্ত আরও লিখছেন, দলীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ছাত্রেরা বিদ্বেষ আর হিংসার চর্চা করতে শেখে। ‘যৌবনের স্বাভাবিক মানবিকতা ও সমাজচেতনা মাঠে শুকিয়ে যায়।’ কথাটা পড়ে আশ্চর্য হলাম। মানবিকতা আর সমাজচেতনার মতো বিদ্বেষ আর হিংসা কি তা হলে স্বাভাবিক নয়? ওই রিপু দুটি কি প্রকৃত সমাজজীবনের বাইরে অন্য কোনও জগৎ থেকে আমদানি করা? বস্তুত, সমাজে যদি বিদ্বেষ আর হিংসা না থাকত, তা হলে তো আইন-আদালত, পুলিশ, রাষ্ট্রযন্ত্র, এ সব কোনও কিছুরই দরকার হত না। রাজনীতিরও প্রয়োজন থাকত না। আমাদেরও এ নিয়ে অহেতুক সংবাদপত্রের পাতা ভরাতে হত না। রাজনীতির প্রধান কাজ তো হিংসা-বিদ্বেষকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। আবার বলি, নিয়ন্ত্রণে রাখা, নির্মূল করা নয়। আমি আজ পর্যন্ত এমন কোনও মানবসমাজের কথা শুনিনি, যেখানে কোনও হিংসা বা বিদ্বেষ নেই। হিংসা-বিদ্বেষ যখন আমাদের চার পাশে অহরহ বিরাজ করছে, তখন নাগরিক সমাজের কনিষ্ঠতম এবং সবচেয়ে সুশিক্ষিত অংশটিকে তার আঁচ থেকে সাময়িক ভাবে আড়াল করে আমরা কী উপকার করব? বহির্বিশ্বকে চেনা আর সামাজিক দায়িত্ব বুঝতে শেখার মধ্যে সামাজিক বিদ্বেষের কারণ উপলব্ধি করা বা রাজনৈতিক হিংসার মোকাবিলা করতে শেখাও পড়ে না কি?
আজকের দলীয় রাজনীতির ভয়াবহ পরিবেশের মধ্যেও ছাত্রছাত্রীরা সকলে যে দলীয় নেতাদের ক্রীড়নকে পরিণত হয় না, তার প্রমাণ হাতের কাছেই রয়েছে। পশ্চিম বাংলার যে-কোনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিলে জানা যাবে, তাদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েক জন মাত্র সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত। অনেকে হয়তো মাঝেমধ্যে মিছিল-সমাবেশে যায়। বৃহত্তর অংশ ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত নয়। যেখানে রাজনৈতিক প্রচার এত ব্যাপক, দলে টানার চেষ্টা এত প্রবল, সেখানে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী যে দলীয় রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে, তার কারণ এই নয় যে তারা স্বভাবতই অরাজনৈতিক। বরং সেটা তাদের সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। রাজনীতি সম্বন্ধে তারা অজ্ঞ নয়, বাস্তব রাজনীতির ভাল-মন্দ দুটোই তাদের অভিজ্ঞতায় আছে। দলীয় সংগঠনের বশংবদ হতে চায় না বলেই দলে যোগ দেয় না। এই তথ্যটি কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থার মূল সাংবিধানিক কাঠামোর সারবত্তাকেই সমর্থন করছে।
তার মানে কি এই যে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গুন্ডামি আর তাণ্ডব আজ প্রায় রোজকার খবর হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা চলতেই থাকবে? সুকান্তের সঙ্গে এখানে আমার দ্বিতীয় মতপার্থক্য আছে। সমস্যাটা সাংবিধানিক অধিকার বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে নয়। সমস্যা হল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ তথা ছাত্রজীবনের অন্যান্য কার্যকলাপ কী পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে। প্রায় সকলেই একমত যে, গোলমালের গোড়ায় রয়েছে কলেজে-কলেজে ছাত্র সংগঠনে বাইরের রাজনৈতিক দল আর নেতাদের অনুপ্রবেশ। কিন্তু রাজনৈতিক দল আর নেতারা যদি স্বেচ্ছায় কলেজ চত্বর থেকে সরে যেতে রাজি না হন, তা হলে এ সমস্যার সমাধান হবে কী উপায়ে? অনেকের মতো সুকান্তের অভিমত হল, সরকারি নিষেধাজ্ঞার জোরে আপাতত নির্বাচিত ছাত্র সংসদ বাতিল করে দেওয়া হোক। কিছু দিনের মতো কলেজের মধ্যে ছাত্র রাজনীতি মুলতুবি থাকুক। ব্যাধিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ওষুধ খাইয়ে সুস্থ করে তোলা যাচ্ছে না, তাই শল্যচিকিৎসা করে রোগাক্রান্ত অঙ্গটিকে বাদ দিয়ে দেখা যাক রোগী ভাল হয় কি না।
আবার বলি, সুকান্ত তাঁর বক্তব্যের তাৎপর্যটা সবটা ভেবে বলেছেন কি না জানি না। কিন্তু আদর্শ রাজনীতি আর কদর্য বাস্তবের বৈসাদৃশ্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে যা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হচ্ছে, তা হল এই যে, আমরা এক আপৎকালে বাস করছি। সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থা্য় যা কাম্য, এমনকী আটপৌরে, আপৎকালে তা বর্জন করাই যুক্তিযুক্ত। গণতান্ত্রিক রাজনীতির পরিধি হয়তো তাতে কিছু সঙ্কুচিত হবে, সরকারি আধিকারিকদের ক্ষমতা হয়তো আরও বাড়বে। কিন্তু উপায় কী? কঠিন অসুখের চিকিৎসা, মেনে নিতেই হবে।
এই আপৎকালের যুক্তিতে নানা ক্ষেত্রে ছোট ছোট এমার্জেন্সি জারি করার প্রবণতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি, গোটা কলেজ স্ট্রিট এলাকায় মিছিল নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। মেট্রো চ্যানেলে সমাবেশ নিষিদ্ধ করার পরিণতি কী হয়েছে, তা তো চোখের সামনেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ব্যতিক্রম ঘোষণা করার ক্ষমতা যার হাতে তুলে দেওয়া হল, সে যে দু’দিন বাদে স্বেচ্ছাচারী হবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। অথচ মৌলিক অধিকার রক্ষার কথা তুললে আমরা অনায়াসে বলে দিই, ও-সব অবাস্তব আদর্শের কথা বইয়ের পাতাতেই থাক। জরুরি অবস্থায় সরকারি নিষেধাজ্ঞাই আমাদের রক্ষাকবচ।
অথচ রক্ষাকবচ আমাদের নিজেদের হাতেই আছে। আমাদের বলতে যারা অধ্যাপক-অধ্যক্ষ-উপাচার্য হয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছি। ঠিক আক্ষরিক অর্থে না হলেও, সাংবিধানিক অধিকারের একটা প্রচলিত নিয়ম হল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বশাসন। ছাত্রবয়সে দেখেছি, মন্ত্রী-আমলা-পুলিশ সকলেই নির্দ্বিধায় মেনে নিতেন যে, উপাচার্য বা অধ্যক্ষ অনুমতি না দিলে পুলিশ কখনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারে না। ১৯৭০-এর বছরগুলোতে নানা ঘটনার ফলে সেই আচরণবিধি বিসর্জিত হয়েছে। কিন্তু যত দূর জানি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ অথবা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অন্যান্য অনুষ্ঠান বা কার্যক্রমের প্রক্রিয়া নির্ধারণের দায়িত্ব এখনও ন্যস্ত রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের হাতে। তাঁরাই ঠিক করতে পারেন ছাত্র সংসদের নির্বাচন কোন নিয়মে হবে, সংসদের দায়িত্ব কী, অধিকার কী, কলেজের মধ্যে বাইরের সংগঠন বা নেতার কোনও ভূমিকা থাকতে পারে কি না, ইত্যাদি। এমনকী, দলীয় ছাত্র সংগঠনের কলেজ শাখা স্বীকৃত হবে কি না তা-ও স্থির করতে পারেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। তা হলে শিক্ষক সম্প্রদায় তাঁদের প্রতিষ্ঠানের স্বশাসনের অধিকার এবং দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে না নিয়ে শুধু ছাত্রদের অপরিণামদর্শিতা আর রাজনীতিকদের ক্ষমতা-লিপ্সাকে দোষ দিয়ে হা-হুতাশ করছেন কেন? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সাম্প্রতিক হামলার পর তাবড় তাবড় মন্ত্রীদের শাসানি সত্ত্বেও উপাচার্য আর রেজিস্ট্রার যে স্বাধিকারবোধ দেখালেন, তা এমন অভিনন্দনযোগ্য ব্যতিক্রম হয়ে আমাদের সামনে হাজির হল কেন? নিজেদের ছাত্র আর কর্মচারীদের পাশে দাঁড়ানো তো যে-কোনও স্বশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবশ্যকর্তব্য হওয়া উচিত ছিল। মনে রাখা যেতে পারে, বেসু-র মতো প্রতিষ্ঠানের রাজনৈতিক পরিবেশে যে আশাতীত পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা কিন্তু সরকারি নিষেধাজ্ঞায় হয়নি। সেখানকার শিক্ষক-কর্তৃপক্ষ স্বশাসনের দায়িত্ব নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে ছাত্রদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন বলেই এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে।
কলেজে কলেজে এই পরিবর্তন আনা যায়, যদি অধ্যক্ষ-অধ্যাপক মিলে তাদের স্বশাসনের অধিকার এবং ছাত্রদের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব নিজেদের হাতে তুলে নেন। এর জন্য রাজনৈতিক দলের সম্মতি প্রয়োজন হয় না, সরকারি আদেশেরও নয়। দরকার শুধু নিজেদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি মমতা আর নিজেদের ছাত্রছাত্রীর ওপর আস্থা। সুকান্তকে আমার জিজ্ঞাসা, এই প্রস্তাবটা কি অবাস্তব?
|
নিউ ইয়র্কে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্বের অধ্যাপক, কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ সাম্মানিক অধ্যাপক |
|
|
|
|
|