|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
‘মিসটেক, মিসটেক’ |
ইংরাজি নববর্ষে নানাবিধ প্রতিজ্ঞা করিবার প্রচলন আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি বাংলা নববর্ষে নূতন একটি রীতি প্রচলিত করিতে চাহেন, স্বাগত। যদি তাহা ভুল স্বীকার করিবার রীতি হয়, দ্বিগুণ স্বাগত। ভুল স্বীকার না করিলে ভুল সংশোধনের প্রশ্ন ওঠে না, স্বীকৃতি শুদ্ধির প্রথম পদক্ষেপ। দেড় বছরের রাজ্যশাসনের পরে মুখ্যমন্ত্রী প্রথম পদক্ষেপ করিলেন, কিঞ্চিৎ বিলম্বিত সূচনা বইকী। কিন্তু কখনও না করিবার অপেক্ষা আঠারো মাস পরে করাও শ্রেয়। অনেক বেশি শ্রেয়। সুতরাং যে কোনও সমালোচনা শুনিয়া ‘মিথ্যা’ বা ‘সাজানো’ ইত্যাদি বিশেষণ প্রয়োগ করিবার পরিবর্তে সারা বছরে ‘দু’তিনটি’ ভুল স্বীকার করিবার দৃষ্টান্তটি নববর্ষের শুভ-ইচ্ছা হিসাবে সসম্মান বরণীয়। আশা করা যায়, অতঃপর মুখ্যমন্ত্রী দ্বিতীয় পদক্ষেপটিও করিবেন। ভুল সংশোধনের পদক্ষেপ। আশা করা যায়, সেই পথে তাঁহার দলীয় সহকর্মীরা তাঁহার অনুগামী হইবেন। আপাতত, আশাটুকুই তাঁহার রাজ্যবাসীর সম্বল।
দুই-তিনটি ভুল বলিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক কী বলিতে চাহিয়াছেন, তাহা লইয়া জল্পনা চলিতেছে। চলুক। আপাতত একটি নির্দিষ্ট বিষয় বিচার্য। দুইটি কারণে বিচার্য। এক, তাহা সাম্প্রতিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। দুই, তাহা মুখ্যমন্ত্রী তথা তাঁহার দলের একটি মৌলিক ভ্রান্তির পরিচায়ক। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত সপ্তাহে ‘বহিরাগত’ উপদ্রবকারীদের তাণ্ডব লইয়া অনেক কথা হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার পরিসরে রাজনৈতিক দলের অনাচারের মূল ব্যাধিটির চিত্র এই ঘটনায় ধরা পড়িয়াছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির নেতৃত্বে যাঁহারা থাকেন, তাঁহারা হয় আদৌ ছাত্র নহেন অথবা ছাত্র হিসাবে নিতান্তই নিষ্ঠাহীন। তাঁহাদের ছাত্র ইউনিয়নে কোনও ভূমিকা পালন করিতে দেওয়াই অনুচিত, নেতৃত্ব তো দূরস্থান। তাঁহারা ‘বহিরাগত’ কি না, তাহা গৌণ প্রশ্ন, তাঁহারা অযোগ্য, ইহাই মুখ্য প্রশ্ন। এই মৌলিক ভ্রান্তি এবং অন্যায় বামফ্রন্টের আমলে সাদর লালিত হইয়াছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বড় কাজ, তাহার সংশোধন করা, পরিবর্তন ঘটানো। পারিবেন? চাহিবেন?
যদি চাহেন, তবে তাঁহাকে আর একটি পা অগ্রসর হইতে হইবে। নিরপেক্ষতার পথে, নিষ্পক্ষতার পথে। প্রেসিডেন্সির ঘটনাতেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠিয়াছে। একাধিক অভিযোগ। মনে করিবার কারণ আছে, সে দিন যাঁহাদের হাঙ্গামা করিতে দেখা গিয়াছে, তাঁহাদের শাস্তিবিধানে প্রশাসন যথেষ্ট তৎপর হয় নাই। অন্য দিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভিতর হইতে আক্রমণ’-এর তত্ত্ব এবং তাহার ভিত্তিতে পাল্টা অভিযোগ ইত্যাদির পরম্পরা কেবল বিসদৃশ নহে, অত্যন্ত আপত্তিকর। আবার সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে ‘তথ্য অনুসন্ধান’-এর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির এক রক্ষীকে এবং এমনকী তাঁহার পরিজনকে যে ভঙ্গিতে যে ধরনের জিজ্ঞাসাবাদ করা হইয়াছে, তাহাও নীতিগ্রাহ্য নয়, বস্তুত অংশত বেআইনিও। এই অনুমান অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, ওই রক্ষী ছাত্রছাত্রীদের প্রীতিভাজন বলিয়াই জিজ্ঞাসাবাদের বহর এত বেশি রকমের। সমগ্র ঘটনাবলিতে দলতন্ত্রের ছাপ অতিমাত্রায় প্রকট। বামফ্রন্ট জমানার এই উত্তরাধিকার কেবল মুছিলেই চলিবে না, মুখ্যমন্ত্রীকে দেখাইতে হইবে যে তিনি ছাপটি মুছিতে আন্তরিক ভাবে আগ্রহী। কেবল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা রক্ষার জন্য নহে, সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তথা সমস্ত পরিসরে। কেবল মহানগরের বুকে নহে, গোটা রাজ্যে। উত্তরবঙ্গে যে ছাত্রকে হাসপাতালে পায়ে বেড়ি পরাইয়া রাখা হয়, তিনি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের ছাত্র, ইহাকে নিতান্ত আপতন বলিয়া মানিয়া লওয়া কঠিন, তাহা মুখ্যমন্ত্রী অন্তত নিজের কাছে স্বীকার করিবেন নিশ্চয়ই— বামফ্রন্ট আমলে তাঁহার দলের অনুগামী কোনও ছাত্রকে পায়ে বেড়ি পরাইয়া রাখা হইলে তিনি দলতন্ত্রের অভিযোগ আনিতেন না? ক্ষমতায় আসিয়া তিনি বড় মুখ করিয়া ঘোষণা করিয়াছিলেন, ‘আমরা-ওরা’র উত্তরাধিকার তিনি বহন করিবেন না। তাহা যে মুখের কথা ছিল না, অন্তত এ বার তাহা প্রমাণ করুন। প্রমাণ করুন, তিনি কেবল তাঁহার অনুগামীদের মুখ্যমন্ত্রী নহেন, গোটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। যদি পারেন, নববর্ষ সত্যই নব বর্ষ হইবে। না পারিলে, ‘মিসটেক, মিসটেক’। |
|
|
 |
|
|