পর্যটক টানে রসগোল্লাও, জানতই না বঙ্গ
মেলবোর্নের কেউ কি শুধু রসগোল্লা খেতে কলকাতায় যেতে পারেন? শুধু রসগোল্লা খাওয়া নয়, তার সৃষ্টি-রহস্য জানতে, ছানা থেকে রসগোল্লা তৈরি শিখতে কোনও অস্ট্রেলীয় চাইলেই কলকাতায় পৌঁছে যেতে পারেন। কিন্তু কলকাতায় কি তাঁদের ইচ্ছাপূরণের ব্যবস্থা আছে?
উত্তর খুঁজছিলেন মেলবোর্নের কারেন রিজ। হতাশ হলেন। ‘ফুড ট্যুরিজম’ বা খাদ্য পর্যটন বলে যে আলাদা করে কিছু হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারও সেই ধারণাটাই নেই। এমনকী সরকারি কর্তাদের কাছেও বিষয়টা একেবারেই নতুন। কারেন বলছিলেন, “আমি শুধু ‘ফুড অ্যান্ড ওয়াইন ট্যুরিজম’-এ আগ্রহী মানুষদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি। অস্ট্রেলিয়ার অনেকেই অন্য দেশে যান শুধু সেখানকার খাবার বা পানীয় চেখে দেখতে। বেড়ানো তো হয়ই। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য থাকে, অন্য দেশের খাবারদাবার সম্পর্কে জানা, তা রাঁধতে শেখা, এর মধ্যে দিয়ে সেই দেশের সংস্কৃতিটাকেও অনুভব করা যায়। কিন্তু যা বুঝলাম, কলকাতার মানুষের এ বিষয়ে কোনও ধারণাই নেই।”
কারেনের দেখা মিলল জয়পুরে ‘দি গ্রেট ইন্ডিয়ান ট্রাভেল বাজার’-এ। পর্যটন মন্ত্রক ও বণিকসভা ফিকি-র আয়োজনে যে সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হল, ভারতে আরও বিদেশি পর্যটক নিয়ে আসা।
পশ্চিমবঙ্গের প্যাভিলিয়নে বিদেশি পর্যটন সংস্থার প্রতিনিধিরা। —নিজস্ব চিত্র
সম্মেলনে হাজির ২৮০টি বিদেশি পর্যটন সংস্থার প্রতিনিধি। যাঁরা তাঁদের মক্কেলদের ভারতে বেড়াতে পাঠাতে আগ্রহী। অন্য রাজ্যগুলির সঙ্গে তাই বিদেশি পর্যটক টানার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গও। রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভীষ্মদেব দাশগুপ্ত বিরাট দলবল নিয়ে জয়পুরে এসে হাজির। সোমবার সকাল থেকেই বিদেশি পর্যটন সংস্থাগুলির কর্তাদের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক চলছে। নিগমের জেনারেল ম্যানেজার দেবল ঘোষ থেকে পর্যটন দফতরের যুগ্ম-অধিকর্তা শিলাদিত্য বসুরায়, প্রাণপণ চেষ্টা করছেন দার্জিলিং থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বোঝাতে। মঙ্গলবার পর্যটন সচিব বিক্রম সেন নিজে এক ঘন্টা ধরে বিদেশি প্রতিনিধিদের সামনে পশ্চিমবঙ্গকে তুলে ধরার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু বিদেশি পর্যটন সংস্থাগুলি যা চাইছেন, তা মিলছে কোথায়? ফিকি-র পর্যটন কমিটির চেয়ারপার্সন জ্যোৎস্না সুরি বলেন, “ভারতে বিদেশি পর্যটকরা মূলত আসেন অবসর সময় কাটাতে। আমাদের সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, ভারতে এই ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি উন্নতির সম্ভাবনা। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ব্যবসা বা চিকিৎসার জন্য ভারতে আসা। সঙ্গে বেড়ানো। তৃতীয় স্থানে থাকছে অ্যাডভেঞ্চার পর্যটন।” পর্যটন মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, বিদেশিরা ভারতীয়দের মতো বেড়াতে এসে এখানে-ওখানে দৌড়ে বেড়ান না। তাঁরা শুয়ে-বসে আয়েশ করেন, গল্ফ খেলেন, এ দেশের সংস্কৃতিটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করেন। তার পরে মানসিক ও শারীরিক ভাবে চাঙ্গা হয়ে কাজের জগতে ফিরে যান। বিদেশি পর্যটক টানতে গেলে এ সবের ব্যবস্থা করতে হবে। পর্যটনে বিষয়ভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে। জয়পুরের সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের প্যাভিলিয়নে এসে অনেকেই খোঁজ করছেন, রাজ্যে আদিবাসী পর্যটনের সুযোগ রয়েছে কি না। পর্যটন দফতরের এক কর্তা বলেন, “আমাদের রাজ্যেও তো রাভা, মেচ, টোটোরা রয়েছে। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি পর্যটকদের সামনে তুলে ধরার কোনও ব্যবস্থা নেই। এই ভাবে এখনও ভাবনাচিন্তা শুরু হয়নি।”
লন্ডনের ভিপ্পি ভাসিন আবার পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে এতটা হতাশ নন। তিনি পশ্চিমবঙ্গে অরণ্য, বন্যপ্রাণী নিয়ে খোঁজখবর করতে এসেছিলেন। সুন্দরবন সম্পর্কে জেনে মুগ্ধ হলেন। বললেন, “ব্রিটেনের পাশাপাশি বেলজিয়ামেও আমার অনেক মক্কেল রয়েছেন। তাঁরা রাজস্থান, কেরল ঘুরে গিয়েছেন। এ বার অন্য কিছু দেখতে চাইছেন। ওঁদের জন্য সুন্দরবন একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা হতে পারে।” তবে একই সঙ্গে তাঁর শর্ত, বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তার সঙ্গে হোটেল ও খাবারদাবারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। বিপদআপদে চিকিৎসার ব্যবস্থা। সে দিকে রাজ্য সরকারকে নজর দিতে হবে।
২০১১ সালের হিসেব বলছে, বিদেশি পর্যটক আগমনের হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ ষষ্ঠ স্থানে। প্রথম পাঁচটি রাজ্যের তালিকায় রয়েছে মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ এবং রাজস্থান। রাজস্থানের প্রায় ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে পশ্চিমবঙ্গ। ২০১১ সালে এ দেশে যত বিদেশি পর্যটক এসেছিলেন, তার ৬.৯ শতাংশ পর্যটক রাজস্থানে পা রেখেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন ৬.২ শতাংশ। তাই জয়পুরে দাঁড়িয়েই রাজস্থানের সঙ্গে রাজ্য পর্যটন উন্নয়ন নিগমের এমডি ভীষ্মদেবের বক্তব্য, “আমাদের লক্ষ্য বিদেশি ধনী পর্যটক। মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, তার সঙ্গে ব্রিটেন ও জার্মানি থেকেও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।” তবে বিদেশি ধনী পর্যটকদের পশ্চিমবঙ্গে টানতে গেলে কলকাতায় আরও কিছু পাঁচ তারা হোটেলের প্রয়োজন রয়েছে বলেও মানছেন তিনি।
মালয়েশিয়ার একটি পর্যটন সংস্থার মালিক ভিনিয়াল সিউ এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে। তাঁর মক্কেলরা সিকিমে আসেন, নেপালে আসেন। সেই সঙ্গে কলকাতা, দার্জিলিং, সুন্দরবন জুড়ে দিয়ে নতুন প্যাকেজ হতে পারে বলে সিউ জানিয়ে গেলেন। একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, কলকাতার দুর্গাপুজো দেখতেই অনেকে আসতে পারেন। কিন্তু সেইধরনের পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। পর্যটন দফতরের কর্তারা মানছেন, সুভাষচন্দ্র বসু, মাদার টেরেজার মতো ব্যক্তিত্বদের নিয়ে অনেকের আগ্রহ রয়েছে। এঁদের স্মৃতিচিহ্নগুলিকে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বেড়ানোর প্যাকেজের কথা ভাবা যেতে পারে। গুজরাতে মহাত্মা গাঁধী বা বিহার-মধ্যপ্রদেশ-উত্তরপ্রদেশে গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলিকে নিয়ে যেমনটা হয়েছে। তবে নতুন সরকার আসার পরে পর্যটন দফতরের বাজেট বরাদ্দ বাড়ায় অন্তত প্রচারটা ভাল হচ্ছে বলে পর্যটন দফতরের কর্তাদের দাবি। ২০১১-১২-তে পর্যটনে বরাদ্দ ছিল মাত্র ৩৮ কোটি টাকা। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০ কোটি টাকা। এ বছর তা আরও বাড়িয়ে ১২০ কোটি টাকা হয়েছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.