খেতের ফসল শুকিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে কালবৈশাখীর জন্য প্রার্থনা করছিলেন চাষিরা। বৈশাখের দ্বিতীয় দিনেই কালবৈশাখী এল, সঙ্গে এল শিলাবৃষ্টি। আর তাতেই মাথায় হাত চাষিদের।
জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা জানান, মঙ্গলবার বিকেলের ঝড়ে জেলায় ১৫৪টি বাড়ি ভেঙেছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে আরও ৩৯৫৯টি বাড়ির। তিনি বলেন, “প্রায় ১৫০০ হেক্টর জমির বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। তাতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ শস্য কমবে। আমেরও ক্ষতি হয়েছে কয়েক জায়গায়। কৃষি দফতরকে সবিস্তার রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।” জেলাশাসক দেড় হাজার হেক্ট জমির ধানে ক্ষতির দাবি করলেও নানা মহকুমার কৃষিকর্তাদের মতে, বেশ কয়েক হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে পাট, তিল চাষেরও। বুধবার মেমারির পাহারহাটি মোড় অবরোধ করেন চাষিরা। তাতে আটকে পড়েন বর্ধমানের মহকুমাশাসক (দক্ষিণ) অরুণকুমার রায়। |
মেমারি ২ এবং ভাতার ব্লক অফিসেও ক্ষতিপূরনের দাবিতে বিক্ষোভ দেখান চাষিরা।
মঙ্গলবার বিকেলে প্রথমে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়। তার পরেই বড় বড় শিলা পড়তে থাকে। জেলায় মন্তেশ্বর, পূর্বস্থলী ও মঙ্গলকোটে শিলাবৃষ্টির তাণ্ডব ছিল সব থেকে বেশি। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে এই বৃষ্টি চলে। মন্তেশ্বরের মাঝেরগ্রাম, শুশুনিয়া পঞ্চায়েত এলাকায় রাস্তায় এক ফুট পর্যন্ত শিলা জমে থাকতে দেখা গিয়েছে বলেও দাবি করেছেন বাসিন্দারা। বুধবার সকালেও নানা এলাকায় বরফের টুকরো পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে।
এ দিন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে পাকা রঙের ধানগাছ। সকালে খেতে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেক চাষি। মন্তেশ্বর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি চাঁদু দাসের দাবি, “আমাদের চারটি পঞ্চায়েত এলাকায় অধিকাংশ খেতের ধানই আর ঘরে তোলার মতো অবস্থায় নেই। প্রায় ষাট শতাংশ বাড়ির ক্ষতি হয়েছে।” জেলাশাসক ১৫০০ হেক্টর জমির ধানে ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করলেও কালনা ও কাটোয়া মহকুমা কৃষি দফতর সূত্রে খবর, আরও অনেক বেশি জমির ধান
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্যোগের সময়ে পূর্বস্থলীর নাদনঘাটে রাজীবপুর গ্রামে দেওয়াল চাপা পড়ে যান রাজা শেখ নামে এক বাসিন্দা। তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
নাদনঘাট অন্নপূর্ণা বালিকা বিদ্যালয়ের দশম ও নবম শ্রেণির দুই ছাত্রী স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে শিলাবৃষ্টিতে আহত হয়। তাদের প্রথমে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পরে কালনা হাসপাতালে পাঠানো হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, নাদনঘাট পঞ্চায়েতের অর্জুনপুকুর, ইসলামপুর, হিজলগড়িয়া, কুন্দপাড়া, আকবপুর, নিমার, ধামাই ইত্যাদি গ্রামে শিলাবৃষ্টির দাপট ছিল বেশি। কালনা মহকুমা কৃষি দফতর জানিয়েছে, কয়েক হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কয়েকশো হেক্টর জমির তিল ও পাট চারা নষ্ট হয়েছে। মহকুমা কৃষি আধিকারিক স্বপনকুমার মারিক বলেন, “শিলাবৃ্ষ্টির জেরে এই মহকুমায় এত ক্ষতি এর আগে কখনও দেখিনি। ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট কৃষি দফতরকে পাঠানো হচ্ছে। |
বর্ধমানের ফরিদপুর গ্রামে শিলায় ঢেকে গিয়েছে ঘর, মাঠ, খেত। |
কাটোয়া মহকুমা কৃষি দফতর সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলকোটের ঝিলু ১ ও ২, নিগন, মঙ্গলকোট, গোতিষ্ঠা-সহ নানা পঞ্চায়েত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গোতিষ্ঠার সনাতন রায়, লাখুরিয়ার বাহাদুর বাগদি, ঝিলু ১ পঞ্চায়েত এলাকার রমজান শেখরা বলেন, “কয়েক দিন আগেও জলের জন্য হাপিত্যেশ করছিলাম। জলের অভাবে ঝলসা রোগ দেখা দিচ্ছিল ধান গাছে। আর এখন তো গাছই ভেঙে পড়ল।” মঙ্গলকোটের সিপিএম বিধায়ক শাহজাহান চৌধুরী প্রশাসনের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন। বুধবার দুপুরে মঙ্গলকোটের বিডিও সুশান্ত মণ্ডল কৃষিকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। মঙ্গলকোট ব্লকে কয়েক হাজার হেক্টর এবং কাটোয়া ১ ব্লকের ক্ষীরগ্রাম পঞ্চায়েত ও কেতুগ্রাম ২ ব্লকে সীতাহাটি, নবগ্রাম, বিল্লেশ্বর পঞ্চায়েতে কয়েকশো হেক্টর জমির ফসলে ক্ষতি হয়েছে বলে কৃষি দফতরের অনুমান। কাটোয়ার কৃষি আধিকারিক (প্রশাসন) রবিউল হক বলেন, “আমরা প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি করছি।”
প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বর্ধমানের বন্ডুল, ভাতার, মেমারিতেও ঝড়বৃষ্টিতে ক্ষতি হয়েছে। ভাতারের আমারুন ২ পঞ্চায়েতের এড়াচিয়ার বাসিন্দা শেখ মোমিনুলের দাবি, “গ্রামের অধিকাংশ চাষির বোরো ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমি ২০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছিলাম। সব নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সামনে মেয়ের বিয়ে। কী ভাবে কী হবে, জানি না।” ভাতারের ভাঁটাকুল, নাসিগ্রাম, ছোটবেলুন, মুরারিপুর, খেরুর-ছাতনি, রামচন্দ্রপুর ইত্যাদি গ্রামেও ফসলে ক্ষতি হয়েছে বলে বাসিন্দারা জানান। মেমারি ২ ব্লকের বিজুর ১ ও ২ পঞ্চায়েত, বড় ও ছোট পলাশন, শ্রীধরপুর, বোহার, ভাণ্ডারডিহি ইত্যাদি গ্রামে কয়েকশো একর জমির ধান নষ্ট হয়েছে বলে চাষিদের অভিযোগ।
ঝড়ে তার ছিঁড়ে ও পোস্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মঙ্গলবার বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটে বহু এলাকায়। তবে জেলাশাসকের দাবি, বুধবার সন্ধ্যার মধ্যে প্রায় সমস্ত জায়গায় বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিক করা গিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে ত্রিপল বিলি করা হচ্ছে বলে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে। |