ভুল নিয়ে ভুলভুলাইয়া! কিংবা ভ্রান্তিবিলাস!
মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরানায় এত কাল ভুল স্বীকারের কোনও চল ছিল না। ইদানীং তাঁর আত্মসমীক্ষায় ভুলের অস্তিত্ব ধরা পড়ছে। প্রায় দু’বছরের যাত্রাপথে শয়ে শয়ে ভাল কাজের মধ্যে কয়েকটা ভুলও হয়েছে বলে মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু কোন ভুল? ভুল চিহ্নিত না-করলে তা থেকে শিক্ষা নেওয়াই বা কী ভাবে? সেই ব্যাপারে কোনও দিশা তৃণমূলে নেই! দলে কোনও আলোচনাও নেই। বরং শাসক দলের অন্দরে বিভ্রান্তি বিস্তর!
বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে বাংলা নববর্ষের দিনে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনের গুটিকয়েক কথায়। কালীঘাটে দলনেত্রীর সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে সংবাদসংস্থাকে ডেরেক সে দিন বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন বিগত দু’বছরে বাংলায় উন্নয়নের শতাধিক উদাহরণ আছে। তার পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে দু-তিনটি ভুলও হয়েছে। নববর্ষে আমরা সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেব।” সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সামনে তৃণমূল নেত্রী ও দলের হয়ে সওয়াল করতেই চোস্ত ডেরেক। তাঁর মুখে মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে ভুল কবুলে বিস্ময় তৈরি হয়েছে তৃণমূল শিবিরেই!
শাসক দলের প্রথম সারির নেতারা একান্ত আলোচনায় মানছেন, কাজ করতে গেলে যে কোনও মানুষেরই ভুল হয়। তাঁদেরও হয়েছে। কিন্তু ঠিক কোথায় ভুল হয়েছে এবং তার সংশোধনীই বা কী এ সব নিয়ে দলে কোনও আলোচনা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীও প্রকাশ্যে কখনও সে সব বলেননি। এই অবস্থায় ডেরেকের মাধ্যমে তাঁর বার্তার তাৎপর্য কী, বুঝে উঠতে পারছেন না তাঁরা। আবার একই সঙ্গে তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের অনেকে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, কাজে ভুল হয়ে থাকলে শিক্ষা নেব এই কথা বলতে পারলে শিক্ষিত, সচেতন জনতার সামনে নিজেদের ভাবমূর্তিই ভাল হয়। তা হলে আবার ভুল চিহ্নিত করতে এত সংশয়, বিভ্রান্তি কেন? বলাই বাহুল্য, নেত্রীর তরফে স্পষ্ট ভাষণের অভাবে দলের নেতারা নিজেদের মতো করে ভুল খুঁজছেন এবং বিভ্রান্ত হচ্ছেন!
ডেরেক অবশ্য তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে বলছেন, নতুন কিছু বলেননি। দু’দিন আগে আনন্দবাজারে সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে যা বলেছিলেন, তিনি তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র। তা ছাড়া, বহু সাফল্যের কথাও তিনি বলেছেন। শুধু ভুলের অংশটাকে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে দেখার কী যুক্তি?
তৃণমূলের অন্দরের সমস্যা অবশ্য এত সহজ যুক্তিতে কাটছে না। দলেরই একাংশ বলছেন, মমতার পূর্বসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বহু বার ভুল স্বীকার করতে দেখা যেত। ক্ষমতা হারানোর পরেও দলীয় মঞ্চ থেকে তাঁকে ভুল-ভ্রান্তি কবুল করতে দেখা গিয়েছে। সে সবই দল হিসাবে সিপিএমের পর্যালোচনার ফসল। কিন্তু তৃণমূলে এই নিয়ে কোনও আলোচনাই নেই। দলের এক বর্ষীয়ান নেতার কথায়, “ভুল হতে পারে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক। ভুল হলে স্বীকার করে নেওয়া যেমন ভাল, তেমন বারবার ভুল করাও কোনও কাজের কথা নয়! যেটা বুদ্ধবাবু করতেন! কিন্তু আমাদের দলে এ সব নিয়ে কোনও আলোচনা তো শুনিনি।” ওই নেতাই উদাহরণ দিচ্ছেন, “কার্টুন-কাণ্ডে শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে গ্রেফতার করা লোকের মতে ভুল। সরকার কি সেটাকে ভুল মনে করে? যদি করে তা হলে ওই ঘটনায় মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ এক বছর ধরে পড়ে আছে কেন?”
আবার ভুল হয়ে যাচ্ছে মেনে মুখ্যমন্ত্রী হয়তো কিছু ক্ষেত্রে আসরে নেমেছেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। যেমন প্রেসিডেন্সি-কাণ্ডে উপাচার্যের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। রং না দেখে গ্রেফতার করতে বলেছেন, কিন্তু তাঁর দলের নেতারাই কখনও বলছেন সিপিএমের চক্রান্ত, কখনও বলছেন প্ররোচনা। তা হলে কি ভুল নিয়ে দলনেত্রী এবং দলের ধারণা আলাদা? সেই প্রশ্নও উঠছে।
নেত্রীরই আর এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বলছেন, “হয়তো কিছু ভুল হয়েছে। সেগুলো শুধরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হবে।” দলের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতার মতে, তাড়াহুড়ো করে সিঙ্গুর বিল, পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডকে ‘সাজানো’ বলা, গোয়েন্দা প্রধান দময়ন্তী সেনকে বদলি, গার্ডেনরিচ-কাণ্ডের জেরে পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দাকে সরানো, সবই ভুল। কিন্তু মানছে কে? মুখ্যমন্ত্রী যে এগুলোকেই ভুল মানছেন, তার নিশ্চয়তা কী? তাই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য প্রশ্ন তুলছেন, “ভুল কি দু-তিনটে? অজস্র! দিল্লিতে গিয়ে যে ঘটনায় এত হইচই, সেখানেও তো মুখ্যমন্ত্রীর ভুল আছে! কিন্তু ভুল তো নিজেকে দাঁড়িয়ে বলতে হবে! ডেরেকের কথায় সিদ্ধান্তে আসা যায় কি?”
ব্যাপার দেখে তৃণমূলের এক সাংসদও বলছেন, “ওঁর (মুখ্যমন্ত্রী) কিছু বলার থাকলে ফেসবুকে বলাটাই ভাল ছিল। যেটা উনি হামেশাই করে থাকেন। হঠাৎ ডেরেক’কে দিয়ে বলানোর কী কারণ ছিল, জানি না!”
এর পর থেকে কি প্রকাশ্যে জনতার সামনেও ভুলের কথা কবুল করতে হবে? সেটাই কি নতুন কৌশল? জানেন না তৃণমূল নেতারা! |