রেলকর্মীদের সঙ্গে সিগন্যাল ব্যবস্থার যন্ত্রও ভুল করায় মুর্শিদাবাদের পলাশি ও রেজিনগরের মাঝে ট্রেন দুর্ঘটনায় এক জনের মৃত্যু হল। তবে যাত্রিবাহী ট্রেন নয়, মালগাড়ি ও একটি খালি ডিজেল ইঞ্জিনের মুখোমুখি ধাক্কায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানেই মারা যান ডিজেল ইঞ্জিনের চালক সুকুমার মুখোপাধ্যায় (৫২)। এই ঘটনায় ৩ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের বহরমপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে তাঁদের কলকাতার বি আর সিংহ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। মৃত ও আহতেরা সবাই ইঞ্জিনের চালক।
রেল সূত্রে খবর, দুর্ঘটনাটি ঘটে সোমবার দুপুর সওয়া একটা নাগাদ। রানাঘাট থেকে একটি মালগাড়ি যাচ্ছিল বহরমপুরের দিকে। পলাশি থেকে ওই ট্রেনের চালক লাইন ক্লিয়ার পান। তাঁর টোকেন (গোলা) নম্বর ২৫। ওই সময়ই বেলডাঙা থেকে রানাঘাটের দিকে আসছিল একটি ডিজেল ইঞ্জিন। তিনি রেজিনগর থেকে লাইন ক্লিয়ার পান। তাঁর টোকেন (গোলা) নম্বর ৩৫। হাতে লাইন ক্লিয়ারের টোকেন নিয়ে দুই ইঞ্জিনের চালকই নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কিন্তু রেজিনগর-পলাশির মাঝে আচমকাই একই লাইনে মুখোমুখি হয়ে যায় ওই দুই ইঞ্জিন। তখন আর ব্রেক কষে দুর্ঘটনা এড়াতে পারেননি চালকেরা। তবে দু’টি ইঞ্জিনেরই গতিবেগ কম থাকায় দুর্ঘটনায় ক্ষতি কম হয়েছে। |
মালগাড়ির চালক বাসুদেব বৈরাগ্য বলেন, “পলাশি ছাড়িয়ে প্রায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পরে লাইনে একটা বড় বাঁক রয়েছে। সেটা ঘুরেই দেখি দুই চাষি সামনে গামছা উড়িয়ে সতর্ক করার চেষ্টা করছেন। তখন বুঝতে পারি কিছু একটা হতে চলেছে। তখনই ব্রেক কষি। তারপরেই সামনে দেখি ওই ইঞ্জিনটিকে।” চালক ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেছিলেন কিন্তু ৪১ কামরার ওই ভারি ট্রেন থামতে থামতে ধাক্কা লেগে যায়। মালগাড়ির চালক এবং সহ চালক চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান।
রবিবারই হাওড়ায় রেলপ্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী রেল পরিষেবায় নানাবিধ ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে বলে স্বীকার করেছিলেন। এই দুর্ঘটনা রেলপ্রতিমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের সত্যতা আর একবার প্রমাণ করে দিল। অধীরবাবু এদিন বলেন, “রেলের কর্তারা দ্রুত লাইন স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।”
দুর্ঘটনার তদন্তে নেমে রেল কর্তাদের চালকের হাতে টোকেন দেখে রেল কর্তাদের চক্ষুচড়কগাছ। তাঁদের বক্তব্য, দুই স্টেশনের সহকারি স্টেশন মাস্টার যদিও ভুল বশত লাইন ক্লিয়ার রয়েছে বলে চালকদের বলে থাকেন তবে ওই ভুল ধরার জন্য স্টেশনে বসানো রয়েছে এক ধরনের যন্ত্র। যার নাম ‘ব্লক মেশিন’। লাইন ক্লিয়ার থাকলে ওই মেশিনের হাতলে চাপ দিলে তবেই একটি করে নম্বর লেখা টোকেন বেরিয়ে আসে। একই লাইনে অন্য ট্রেন থাকলে ওই মেশিন থেকে টোকেন বের হবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও কী করে বেরিয়ে এল ওই টোকেন?
পূর্ব রেলের সদর দফতর থেকেও অফিসারেরা ঘটনাস্থলে যান। রেলের অফিসারেরা রাত পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেননি কী ভাবে দুই ইঞ্জিনের চালকই একই সঙ্গে লাইন ক্লিয়ার পেলেন। এই ঘটনা খুবই বিরল বলে দাবি করে রেলের প্রাক্তন কর্তা সুভাষরঞ্জন ঠাকুর বলেন, “পূর্ব রেলের উচিত খুব ভাল করে তদন্ত করা। এর আগে এমন ঘটনা দেখিনি।”
দুর্ঘটনার পরে কৃষ্ণনগরের পর থেকে ওই লাইনে ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ে লোকাল ও প্যাসেঞ্জার ট্রেনগুলি। দুর্ঘটনার খবর পেয়েই রেলের ‘অ্যাক্সিডেন্ট রিলিফ ট্রেন’ ও মেডিক্যাল ভ্যান ঘটনাস্থলে যায়। সন্ধ্যা নাগাদ লালগোলা থেকে বেলডাঙা ও শিয়ালদহ থেকে দেবগ্রাম পর্যন্ত রেল চলাচল করতে শুরু করে।
এদিকে, এ দিনই আসানসোল ডিভিশনে গিরিডির কাছে মধুপুর-গিরিডি প্যাসেঞ্জারের ইঞ্জিন আলাদা হয়ে যায়। বেশ কয়েক’শো মিটার চলে যাওয়ার পরে চালক বুঝতে পারেন তাঁর পিছনে কামরা নেই। কামরাগুলিও অবশ্য কিছুদূর গিয়ে আপনা হতেই থেমে যায়। প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে ইঞ্জিন লাগিয়ে ফের ট্রেনটি চালানো হয়। তবে কেউ হতাহত হননি। |