মোদীতে অনড় বিজেপি, তাই এনডিএ ছাড়ার পথে নীতীশও
সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। শুধু ঘোষণাটাই বাকি।
একটানা ১৫ বছরের জোট সম্পর্ক ভেঙে একে অন্যের বিরুদ্ধে ময়দানে নামার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করে ফেলেছে বিজেপি ও জেডিইউ। কে আগে বিচ্ছেদের কথা ঘোষণা করবে, আপাতত টানাপোড়েন তা নিয়েই। সব মিলিয়ে লোকসভা ভোটের এক বছর আগে এনডিএ-তে ভাঙন এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা।
নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে নীতীশ কুমারের তীব্র আপত্তির কথা জানার পরেও সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপি জানিয়ে দিয়েছে, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীই হবেন পরবর্তী নির্বাচনে এনডিএ জোটের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। যার পরে নীতীশ বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহকে জানিয়ে দিয়েছেন, মোদী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হলে তাঁর দল এনডিএ জোট ছাড়বেই। এমনকী মোদী যদি ‘স্বঘোষিত দাবিদার’ হিসেবেও রাজ্যে-রাজ্যে প্রচার চালিয়ে যান, তা হলেও নীতীশের পক্ষে জোটে থাকা সম্ভব নয়। অর্থাৎ যে কোনও অবস্থাতেই ‘নো-মোদী’!
কিন্তু মোদীর ব্যাপারে নীতীশের এতটা বিরাগ কেন? রাজনাথকে সেটাও বুঝিয়েছেন নীতীশ। তিনি জানিয়েছেন, মোদীকে সামনে রেখে প্রচারে নামলেই বিহারের সংখ্যালঘু ভোট লালুপ্রসাদ যাদব এবং রামবিলাস পাসোয়ানের দিকে চলে যেতে পারে। তার উপর কংগ্রেস যদি তাদের সঙ্গে থাকে, তা হলে সমস্যা বাড়বে। এই অবস্থায় মোদীকে সামনে রাখার যে সিদ্ধান্ত বিজেপি ও সঙ্ঘ নিয়েছে, তার পরে তাঁর সামনে অন্য পথ নেই। না চাইলেও তাই এনডিএ জোট ছাড়তে হচ্ছে। নীতীশের সিদ্ধান্ত জানার পরে রাজনাথ তাঁকে বলেছেন, “যা পরিস্থিতি, তাতে মোদীর ছবি সামনে রেখে ভোটে না গেলে বিজেপি কর্মীদের হাতে লাঞ্ছনার শিকার হতে পারি!” অর্থাৎ, ‘মোদী-ই’।
দীর্ঘ দিনের দুই জোট শরিকই একে অপরকে তাদের বাধ্যবাধকতার কথা জানিয়ে দিয়েছে। আগামী মাসে কর্নাটকে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে বিজেপির ফল ভাল হবে না বলে এক রকম নিশ্চিত দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। কর্নাটক ভোটের পরে, জুন মাসে গোয়ায় বসবে বিজেপির কর্মসমিতির বৈঠক। সেখানেই মোদীর কার্যত রাজনৈতিক অভিষেক হবে বলে এখনও পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়ে রয়েছে দলে। বিজেপির এক শীর্ষ নেতা অবশ্য বলেন, “কর্নাটক ভোটের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। কর্নাটকে মোদী প্রচারের ব্যাপারে খুব একটা সক্রিয় হচ্ছেন না। জুন মাসে কর্মসমিতির পরে মোদী কী ভাবে প্রচারে নামেন, তার উপরেই নীতীশের অবস্থান নির্ভর করছে।” তা হলে কি নীতীশ এনডিএ ছাড়ার আগেই বিজেপি বিহার থেকে তাদের মন্ত্রীদের প্রত্যাহার করে নেবে? বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্বের বক্তব্য, তাঁদের কৌশল হল, নীতীশ কবে সমর্থন প্রত্যাহার করছেন, সেটা দেখা। তার পরে পরবর্তী পদক্ষেপ।
এ বার দিল্লিতে এসে নীতীশ যখন অরুণ জেটলির সঙ্গে বৈঠক করেন, তখন তিনি বলেছিলেন, তাঁর দল এখনই এনডিএ ছাড়তে চায় না। তবে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক ও লালুপ্রসাদের কথা মাথায় রেখে ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাব দেখানো জরুরি। দিল্লিতে তাদের সম্মেলনের আগে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করার জন্য বিজেপিকে প্রথমে দু’সপ্তাহ সময় দেয় জেডিইউ। কিন্তু জেটলি-নীতীশ বৈঠকের পরে সেই সময়সীমা আট মাস বাড়িয়ে দেওয়া হয়। বিজেপি নেতাদের বক্তব্য, প্রথম দিকে দু’পক্ষে একটা শান্তির পরিবেশ ছিল। কিন্তু জেটলিকে নীতীশ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা থেকে তিনি সরে এসেছেন বলে অভিযোগ বিজেপির। দলের বক্তব্য, জেটলির সঙ্গে কথার পরেও রবিবার টানা পঁয়ত্রিশ মিনিট ধরে নাম না করে মোদীর বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন নীতীশ। এর পরই বিজেপির শীর্ষ নেতাদের লাগাতার ফোন-এসএমএস করতে শুরু করেন ক্ষুব্ধ কর্মীরা। তাঁদের তখন একটাই প্রশ্ন, মোদীর বিরুদ্ধে নীতীশ যখন এত আক্রমণাত্মক মন্তব্য করছেন, তখন বিজেপি নেতারা কী করছেন?
যা পরিস্থিতি, তাতে মোদীর ছবি সামনে রেখে ভোটে না গেলে বিজেপি কর্মীদের হাতে আমরাই লাঞ্ছনার শিকার হতে পারি!
রবিবার বিকেলে লালকৃষ্ণ আডবাণীর বাড়িতে বিজেপির শীর্ষ নেতাদের একটি বৈঠক নির্ধারিত ছিল। তাতে আলোচ্য ছিল সংসদ শুরুর আগে সরকারের বিভিন্ন বিল নিয়ে অবস্থান নির্ধারণ করা। কিন্তু নীতীশের মন্তব্য জানার পরে পরিস্থিতি দ্রুত বদলায়। সঙ্ঘ নেতৃত্ব রাজনাথকে বলে দেন, বিজেপি এখনই বিবৃতি না দিলে দলের কর্মী-সমর্থকদের মনোবল ধরে রাখা যাবে না। বিজেপি নেতারাও বিস্মিত হন যে, নীতীশ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। অবশেষে সঙ্ঘের পরামর্শ মেনে নীতীশকে জবাব দিতে একটি কড়া বিবৃতির খসড়া তৈরি করা হয়। জেটলি খসড়াটি তৈরি করেন।
এমন নয়, বিজেপির সব শীর্ষ নেতা মোদীর পক্ষ নিয়ে নীতীশের বিরোধিতা করতে চেয়েছিলেন। বিজেপির চার শীর্ষ নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী, সুষমা স্বরাজ, যশোবন্ত সিংহ ও যশবন্ত সিন্হা এখনও মোদীকে আটকাতে চাইছেন। তাঁদের যুক্তি, মোদীর নাম ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনাতেই যদি এনডিএ ভেঙে যায়, তা হলে সরকার গড়ার স্বপ্ন কী করে বাস্তবায়িত হবে? কারণ, একার ক্ষমতায় বিজেপি সরকার গড়তে পারবে না। সরকার গড়তে শরিকদের সমর্থন দরকার। সঙ্ঘের পাল্টা যুক্তি, বিজেপিকে এখন নিজের শক্তি বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে। অতীতে যেমন বিজেপি নিজের শ্রীবৃদ্ধির কথা ভেবেছে, তেমনই লোকসভা ভোটে যতটা সম্ভব নিজের ক্ষমতায় আসন বাড়ানোর লক্ষ্যে এগোতে হবে। সে ক্ষেত্রে যদি সরকার গড়তে না-ও পারা যায়, তা হলেও ক্ষতি নেই। দল তখন বিরোধী আসনে বসবে। কিন্তু বিজেপির আসন বাড়াতে গেলে যে মোদীকে সামনে রেখেই এগোতে হবে, তাতে সন্দেহ নেই।
প্রশ্ন হল, বিজেপির সঙ্গ ছাড়লে নীতীশের কী লাভ? বিজেপির জোরেই বিহারে উচ্চবর্ণের ভোট পেতেন নীতীশ। সেই উচ্চবর্ণের ভোট বাদ দিলে শুধু মুসলমান ও অনগ্রসর শ্রেণির ভোটের জোরে কি উতরে যাবেন নীতীশ? জেডিইউ সূত্রের মতে, নীতীশ ভেবেছিলেন, মোদী শরিকদের সমর্থন পাবেন না। সে ক্ষেত্রে তাঁর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভবও নয়। আর মোদী যদি প্রধানমন্ত্রী না-ই হতে পারেন, তা হলে তাঁর বিরোধিতা করে নিজের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করার সুযোগ নীতীশ কেন হাতছাড়া করবেন? তিনি সেই সূত্র ধরেই এগোচ্ছিলেন। সেই সূত্র মেনেই বিজেপি নেতৃত্বকে জানান, আর যা-ই হোক, এখনই তিনি কংগ্রেসের সঙ্গে যাচ্ছেন না। অন্তত ২০১৪ সাল পর্যন্ত। এ-ও বলেছিলেন, বিজেপির সঙ্গে জোট বেঁধেই তো তিনি ছ’বছর কেন্দ্রে মন্ত্রী ছিলেন। ছ’বছর রাজ্যেও ক্ষমতায় রয়েছেন। তাই এখনই বিজেপি-সঙ্গ ছাড়ার কথা ভাবছেন না। তবে রাজ্য-রাজনীতির অঙ্ক মাথায় রেখে যথেষ্ট কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাবেন।
এই অবধি সবই ঠিক ছিল। চিত্রনাট্য মেনেই সব এগোচ্ছিল। কিন্তু জেডিইউ নেতারা বলছেন, নীতীশের মন্তব্যের পর বিজেপি যে এত দ্রুত এত কড়া প্রতিক্রিয়া দেবে, তা অঙ্কের বাইরে ছিল। রবিবার আডবাণীর বাড়িতে যে বিবৃতির খসড়া তৈরি হয়, সেখানে নীতীশের নাম করা হয়নি। কিন্তু গত কাল বিজেপির নতুন মুখপাত্র মীনাক্ষী লেখি যে ভাবে নীতীশের নাম করে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তাতেই ঘুরে গিয়েছে সব অঙ্ক। বিজেপি নেতারাই বলছেন, মীনাক্ষীকে দিয়ে এতটা কড়া মন্তব্য করার ছক ছিল না। মীনাক্ষী আগ বাড়িয়ে গোধরার সময় নীতীশের রেলমন্ত্রী থাকার কথা তুলেছেন। যে মন্তব্য আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। রবিবার বিজেপির প্রতিক্রিয়া নিয়ে সোমবার রাত পর্যন্ত নীতীশ মুখ খোলেননি। কিন্তু মীনাক্ষীর মাধ্যমে বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য জানার পরেই আজ মুখ খোলেন তিনি। আজ নীতীশ জানান, রেল মন্ত্রকের কাজ রেলের সুরক্ষা বজায় রাখা। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা রেলের নয়। ওটা রাজ্যের সমস্যা। তিনি আরও বলেন, “তৎকালীন রেলমন্ত্রী হিসেবে আমি সংসদে সব তথ্য জানিয়েছিলাম। সব প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছি।” বিজেপি কোনও মন্তব্য করেনি আজ। আপাতত তারা অপেক্ষায় আছে বিহারে একটি উপনির্বাচনের। যেখানে উচ্চবর্ণের ভোটও থাকবে। বিজেপি-সঙ্গ ছেড়ে সেই ভোটে যদি নীতীশ হেরে যান, তা হলে কী হবে? তিনি কি সিদ্ধান্ত বদলাবেন? ফের একজোট হবে জেডিইউ-বিজেপি? বিজেপি নেতারা আপাতত আশায়। আর অপেক্ষায়।

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.