এই তো গেল বার পয়লা বৈশাখে কত ফিতে কাটা, কত শিল্যান্যাস। এ বছরের পয়লাও পেরলো।
নতুন বছর কেমন কাটবে, পঞ্জিকাও জানে না। কিন্তু যে বছরটা চলে গেল, সে খুব ভরসা জাগিয়ে গেল কি? |
তাসের মতো বর্ষপঞ্জি দিয়ে গেল এক জন। বাংলায় নতুন বছরের উপহার। এই একটা তাস পার হতে কত ক্ষণ! এই তো গেল বার পয়লা বৈশাখে কত ফিতে কেটেছি, কত শিল্যান্যাস করেছি। দেখতে দেখতে এ বছরের পয়লাও পেরলো। বয়ে যাওয়া সময় দ্রুত ক্ষুদ্র হয়ে ওঠে। কত কাজ ভাবা থাকে, কত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না। মুখ ঢাকতে হামবড়াই ছাড়া গতি কী! বলতেই হয়, সব কথা রেখেছি। সব কাজ করেছি। একশোয় একশো।
যদিও, কথা শুনে, আমাদের পাড়ার নেড়িটা পর্যন্ত অবাক। ক’দিন আগে খোলা গর্তে পড়ে ওর দুটি ছানা মরেছে। একশো শতাংশ কাজ সব ম্যানহোলের মুখে ঢাকনা দিতে পারেনি।
সে যাক গে! ভারী তো ঝরতি-পড়তি প্রাণ! মানুষেরই কোনও ঠিকঠিকানা নেই! এই বছরখানেক আগেই তো, পূর্ব কলকাতার নোনাডাঙা থেকে উচ্ছেদ করতে হল কিছু পরিবারকে। সরকারি খাসজমিতে জবরদখল ঠেকাতে সরকারি অভিযান। কারও কিছু বলার ছিল না। তাও ক’জন দুষ্টু লোক দল পাকিয়ে সভা-টভা করে বলতে লাগল, অন্যায়, এ চলবে না! |
‘কতিপয় বোকা বুদ্ধিজীবী’! |
কী ভয়ানক! এত দিন যারা ‘চলবে না’ বলে জীবন অচল করে ছাড়ত, জমি নিতে হবে বলে যারা আটকে দিয়েছে রাস্তা বাড়ানোর কাজ, ফসলি জমিতে কারখানা তোলা যাবে না বলে পোড়া শিল্পের কবর খুঁড়েছে স্বহস্তে, তারাই এখন সিংহাসনের ভোগদখলে। ভেবেছিল, চালানোটা চলতে না দেওয়ার মতোই সহজ। ভেবেছিল, এত কালের প্রতিরোধের অধিকার, বিরোধী থেকে শাসক হওয়ার পরও একচেটিয়া তাদেরই পকেটে পকেটে ঘুরছে। খবদ্দার। টুঁ শব্দটি করেছ কি মরেছ। মাওবাদী বলে কেস খাইয়ে দেবে। মাওবাদীদের চারটে শিং, ছ’টা কান। তাই উঁচু মঞ্চে উঠলেই এক নজরে চেনা যায়। চৌত্রিশ বছর ধরে ওরা সব অকেজো করে রেখেছে গো। তাই মুখ্যমন্ত্রীই মাওবাদী ধরেন, তাঁকেই থানায় হুমকি দিয়ে ক্যাডার ছাড়াতে হয়, হাড়বজ্জাত কিছু সাংবাদিক আর মিডিয়ার অপপ্রচার বন্ধ করতে তাঁকেই মাচা বেঁধে মাইক নিয়ে প্রচার করতে হয়। এগুলো অবশ্য একশো ভাগ কাজের পরে একশো এক একশো দুই। ‘চলবে না’-কে চালানো কি মুখের কথা? সময় দিতে পারছ না এট্টু? চৌত্রিশ বছরে ওরা ভান্ড ফাঁক করে দিয়েছে, আমরা তো এই এলুম। এট্টু জিরোই। আমাদের ভাইবোনেরা দু’গাল মুড়ি-নারকোল খাক। আমাদের সরকার ‘জনস্বার্থবাহী গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সরকার’, না হয় রেলটা বেয়াড়া মেজ ভাইয়ের থেকে নিয়ে ছোট ভাইকে দিয়েছিল, তাই বলে কার্টুন আঁকবে? জনে জনে দেখবে আর হাসবে? চক্রান্ত! সব অলপ্পেয়ে ড্যাকরা। জানে না, পরিবর্তন মানে হাসি নিষেধ? এ হল বাংলার নতুন যুগ। নতুন মুখ। নতুন ভাষা। এ বাংলায় ধর্ষণ হতে পারে না। খুন জখম চুরি ডাকাতি ঘুষ স্বজনপোষণ পরীক্ষায় ফেল আত্মঘাতী চাষি ভাঙা রাস্তা তোলাবাজি ইউনিয়নবাজি মার্কেট ও বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড, কিচ্ছু হয় না। হলেও সব চক্রান্ত। অপপ্রচার। আমরা স্বীকার করি না। প্রাইভেট হাসপাতালে আগুন লেগে লোক মরল, মদ বিষ হয়ে গেল, তো আমরা কী করব? তাও তো টাকা দেব বলেছিলাম। জনস্বার্থ মামলা করে হুড়কো দিয়ে দিল। আমরা ধর্মনিরপেক্ষ। দলতন্ত্র নয়, এ গণতন্ত্রের সরকার। তাই বলে ভোটের সময় মুসলিমপ্রধান এলাকায় হিন্দু প্রার্থী দেব নাকি? কথা হচ্ছে, বদলা নয় বদল চাই আমরা বলেছিলাম। কথা রেখেছি। ক্ষমতায় আসার পর এক বিন্দু রক্তপাত হয়নি। দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তা সব দলেই কিছু মাথাগরম অর্বাচীন থাকে। তারাই তো দেশের ভবিষ্যত্। কী টগবগে তরুণ সব ছেলেমেয়ে। চৌত্রিশ বছর ধরে ওরা চৌত্রিশ বার গুলি চালিয়েছে, সে-সব বাঙালি বেমালুম হজম করে গেল, তা আমরা মাত্র একটা লোবা গ্রাম বন্দুক নিয়ে আমাদের একটু খেলু করতে ইচ্ছা হয় না? আমার পুলিশ যদি গুলি করে, যদি ছাত্র পিটিয়ে মারে, সে সব তুচ্ছ ব্যাপার, তবু আমি দাক্ষিণ্য বিলোবই। ওরা বারাসতের ভাই-মরা দিদিটাকে চাকরি দেয়নি? আমরাও দেব। ওরা ইট মারলে ডান্ডা মেরে ছাতু করে দেব ওদের। মাটি খুঁড়ে বার করে আনব সব কঙ্কাল, সব্বাই সাক্ষ্য দেবে কে তাদের মেরে কোন রঙের জামা পরিয়ে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিল। আমার পুলিশ সব করবে। তা-ও এত কথা! পরিবর্তন আনিনি? পার্ক ও সেতুগুলো সাদা-নীল করিনি? চৌত্রিশ বছরের অন্ধকার দূর করে দিইনি রাজ্য জোড়া ত্রিফলা আলোয়? পশ্চিমবঙ্গ এখন অনেক ব্যাপারেই এক নম্বর তা জানো? একদম নিন্দে করবে না। ধর্ষণ হয়েছে বিবৃতি দিলেই নির্বাসন দেব, সেবাযত্নে এক চুল ত্রুটি হলেই বলব, বলব, একশো বার বলব তোমাদের থাপ্পড় মারা উচিত। আই পি এস, আই এ এস, নির্বাচন কমিশন, প্রধানমন্ত্রীআমরা কাউকে রেয়াত করি না!
কতিপয় বোকা বুদ্ধিজীবী বিদ্বজ্জনেরা তো আমাদের দলে যদি ভেবে থাকে এ-সব নিয়ে লম্বা লম্বা জনগণের মিছিল করবে, সে গুড়ে বালি। আমরা জানি কী করে চুপ করাতে হয়। যেগুলো মরে হেজে গিয়েছে, তাদের ফোটোয় মালা দাও, যারা বেঁচে আছে, তাদের বিভূষিত করো। চাঁদ থেকে জোনাকি সব এক সারিতে বসাও। মানপত্র, দানপত্র, ভাতা, শাল হুঁ হুঁ বাবা! এর নাম গণতন্ত্র। এখানে মুড়িমুড়কি এক দর। কেউ যদি তোমার ডাকা মিছিলে না আসে, তোমার জয়গান না গায়, তুমি মহান, তুমি অভিনন্দন পাঠিয়ে তার নামটা দাও কাগজে ছেপে। ‘অভিনন্দন’ লিখতে ‘অভিন্দন’ হয়েছে, কুছ পরোয়া নেই, পরের বার ‘অভিননন্দন’ লিখে দিয়ো, কমপেনসেশন হয়ে যাবে। মোদ্দা কথা, যা ছাড়তে হয় ছাড়ো, যা দিতে হয় দাও, শস্তায় জনপ্রিয় হওয়ার একটাও সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। ছিনিয়ে নাও মান্যজনের শবযাত্রা। লোকটা বেঁচে থাকতে অপমান-টপমান যদি করে থাকো, ভুলে যাও। মৃত্যুশোক হল পাবলিকের সেন্টিমেন্ট। ভোটারের সেন্টিমেন্ট বললেও আমরা রাগ করব না দিদিভাই।
আচ্ছা, এস ই জেড-এ কি ভোটার বাড়ায়? না? তবে চুলোয় যাক। পরমাণু বিদ্যুত্? কী দরকার? ও-সব করলে কেন্দ্রের লাভ। ওই কেন্দ্র, ওরা আমাদের বাংলার মাকে বঞ্চনা করছে, বাংলার মাটিকে লাঞ্ছনা করছে, বাংলার মানুষকে গঞ্জনা করছে। ও, গঞ্জনা এখানে বসবে না? কী সুন্দর কথাটা, বেশ স্লোগানের মতো। যাক গে, শোনো, আজ থেকে আমাদের বিদ্যুত্ ব্যাঙ্কের সব বিদ্যুত্ মাটির জালায় ভরে রাখবে। আমাদের মৃত্শিল্প তথা কুটিরশিল্পের রমরমা হবে। তাই দেখে গানশিল্প, নাচশিল্প, কাব্য-নাটক-ফিলিম শিল্প ফলফলিয়ে ওঃ! কী সাফল্য! শিল্প সামগ্রী একাকার। আমাদের কীর্তি দেখে ওদের তো হিংসে হবেই। এত কাল ওরা হিংসার রাজনীতি করেছে। ওদের সন্ত্রাসের লাল মরুভূমিতে আমরা আশ্বাসের সবুজ কুচি কুচি ফুল ফোটাচ্ছি। এক হাসপাতালের ডাক্তারকে এমন তুলোধোনা করেছি, সব হাসপাতাল এখন সত্ আর কর্মনিষ্ঠ। ওদের কোন মরোমরো নেতাকে নাকি কোন হাসপাতাল ভর্তি নেয়নি। তা আমরা কী করব? সবেতেই ওদের রাগ। মোড়ে মোড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজিয়ে চৌত্রিশ বছরের অপসংস্কৃতিতে কুলোর বাতাস দিলেও নিন্দে। বলে কিনা, আমাদের প্রতিষ্ঠা দিবসে মঞ্চ বেঁধে অশালীন নাচ হয়েছে। আরে ওটা তো শিল্প। তা ছাড়া রুজিরোজগারের প্রশ্ন নেই? না নাচলে মেয়েগুলো খাবে কী! আমাদের জোয়ান ছেলেগুলো রাতদিন জনস্বার্থে খাটছে, একটু আমোদ করবে না? শিল্পপতিদের নিয়ে কেত্তন গাইলেও ওদের নিন্দেমন্দ। শুধু গাড়ির কারখানাই শিল্প? খোল কত্তাল হারমোনি, এগুলো কিছু নয়? ল্যান্ডব্যাঙ্ক থাকলেই শিল্পপতিদের জমি দিয়ে দিয়ে আবদার মেটাতে হবে? ওরা জানে না, কৃষি আমাদের প্রেরণা, শিল্প আমাদের চেতনা? এক বছরে দশ লক্ষ বেকারের চাকরি হয়েছে বলে আমরা দাবি করি। টাটা আর ইনফোসিস এলে কি পশ্চিমবাংলার দুটো পাখা গজাত? আমার পশ্চিমবাংলা, আমরা ঠিক করব জোট রাখব না ভাঙব। আমরা ঠিক করব কোন নির্বাচন কবে কোথায় কী ভাবে হবে। দরকার হলে সব্বার সঙ্গে কোঁদল করব, সব্বাইকে কোতল করব। আমরা ভালমানুষের দল, সন্ত্রাস ছড়াতে চাই না। কিন্তু রেগে গেলে আমরা ভয়ঙ্কর। ধর্ম থেকে জিরাফ হতে আমাদের এক মিনিটও লাগে না।
এই হল মুশকিল। কেউ কিছু বোঝে না। এ রাজ্য এখন পর্যটনশিল্পে এক নম্বর। ভাবলাম, কলকাতা নামে লন্ডনের কূটকচালি ছেড়ে উত্তরবঙ্গ নামে সুইজ়ারল্যান্ডের কোনও বনে দু’দিন কাটিয়ে আসি। বুকিং-এর জন্য ফোন করা হল, ফোন ধরে না। সশরীরে উপস্থিত হতে, বিরক্ত ভাবে হাঁকিয়ে দিচ্ছিল। আমাদের শাসক দলের এক তা-বড় নেতার নাম করতেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কী দারুণ পরিবর্তন! ত্রিশ টাকা প্রাপ্য ফেরত দিতে পারল না। বলে, কাল আসুন। যাওয়া যেতেই পারে। একশো ভাগ কাজ তো কবেই সারা হয়েছে। এখন তৃপ্ত অবসর। কী? আমরা ভাল না? হতেই হবে। |