বিশ্বজিত্ রায় (‘ওরা পাঠায় মৃত্যুর পথে’, ৭-৪) যথার্থই লিখেছেন, ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করতেন না। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ও রবীন্দ্রনাথ খুব ভাল বন্ধু ছিলেন। জগদীশচন্দ্র যখন ইউরোপে গবেষণা করছেন, তখন বাংলাদেশে তীব্র স্বাধীনতার লড়াই চলছে। জগদীশচন্দ্র অস্থির হয়ে উঠলেন। বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখলেন, গবেষণা ছেড়ে দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে যোগ দিতে চান। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে নিষেধ করে উত্তর দিলেন, উচ্চমানের গবেষণাই আসল স্বাধীনতার লড়াই। প্রসঙ্গত, আর এক বিশ্বখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর বাবা সুরেন্দ্রনাথ বসুর কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ছেলেকে দুটি বিষয়ে সব সময় নিষেধ করতেন। এক, স্বদেশি কোরো না। দুই, গানবাজনা কোরো না। এ সব কথা হয়তো অনেকে জানেন। তবুও প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করি, প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় সুভাষচন্দ্র বসু ওটেন সাহেবকে পিটিয়েছিলেন ভারতীয়দের সম্পর্কে কটূক্তি করার জন্য। ছাত্রদের এই আচরণ রবীন্দ্রনাথ সমর্থন করেননি। ১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ বাঁকুড়ায় এসেছিলেন। সেখানে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে ছাত্রসমাজের উদ্দেশে বলেছিলেন, “যারা অকুণ্ঠিত মনে নিয়ম ভাঙতে চায়, তারা নিয়ম গড়তে পারে না। এই ভাঙন ধরানো মন সাংঘাতিক ভাবে বিস্তার লাভ করছে।...” রবীন্দ্রনাথ যে কেবল ছাত্রদেরই রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সমর্থক ছিলেন তা নয়, সাহিত্যিক বা স্রষ্টাদের ক্ষেত্রেও একই মনোভাব পোষণ করতেন। উদাহরণ: রবীন্দ্রনাথ বনফুলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোমার পলিটিক্সের দিকে ঝোঁক আছে নাকি?’ বনফুল: ‘না’। রবীন্দ্রনাথ: ‘ভাল। সাহিত্যিক পলিটিক্স করলে পলিটিক্স হয় না, সাহিত্যও মার খায়। আমি পলিটিক্স করতে গিয়ে খুব ঘা খেয়েছিলুম।’ মৃণালকান্তি মাইতি। মেজিয়া তাপবিদ্যুত্ প্রকল্প, ডিভিসি, বাঁকুড়া
|
আমি যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে চাই না। বিশ্বজিত্ রায়ের লেখার সূত্র ধরে যুদ্ধবিরোধী কিছু কবিতা-গল্প-উপন্যাসের কথা স্মরণ করতে চাই। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে উইলফ্রেড ওয়েন, রুপার্ট ব্রুক এবং সিগফ্রিড সেসুন-এর কথা মনে পড়ে। এঁদের অনেকেই বাধ্য হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েছিলেন। তাঁরা যুদ্ধবিরোধী কবিতা লিখেছিলেন। এঁদের বলা হত ওয়র পোয়েটস। এঁরা যে-কোনও ধরনের যুদ্ধ ও রক্তপাতের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। উইলফ্রেড ওয়েনের একটি বিখ্যাত কবিতা দ্য শেড অফ। উইলফ্রেড ওয়েন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। তাঁর প্যান্টের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘গীতাঞ্জলি’র একটি ইংরেজি সংস্করণ। সেই রক্তমাখা ‘গীতাঞ্জলি’র কপিটি তাঁর মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শোকাহতা তাঁর মা একটি চিঠি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। এই দুর্ভাগ্যবতী মা জানতেন না, রবীন্দ্রনাথ কে? তিনি খামের ওপরে লিখেছিলেন MR. R N Tagore, India. অনেক পথ ঘুরে সেই চিঠি রবীন্দ্রনাথের কাছে পৌঁছেছিল শান্তিনিকেতনে। মিসেসে ওয়েনের সামান্য বক্তব্য এটুকু ছিল যে, ‘আমার হারিয়ে যাওয়া ছেলে হয়তো আপনার এই বইটা পড়ে শান্তি পেয়েছিল। আমার ছেলের যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তিম মুহূর্তে আমি তার পাশে ছিলাম না। আপনি ছিলেন। আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ রইলাম।’ সেই পত্র এখনও খুঁজলে হয়তো বিশ্বভারতীর প্রদর্শশালায় দেখতে পাওয়া যাবে। এরিক মারিয়া রেমার্কের কথায় আসি। ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ ছাড়াও তাঁর আর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ আছে। নাম ‘থ্রি কমরেডস’। বিশ্বজিত্বাবু লিখেছেন যে, ১৯৮২ সালে রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ করেছিলেন সুধীন্দ্রনাথ রাহা। সম্ভবত, ১৯৫০-এর দশকে ‘থ্রি কমরেডস’ উপন্যাসটির বাংলা অনুবাদ করেছিলেন শান্তিনিকেতন তথা বিশ্বভারতীর প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বঙ্গানুবাদটির নাম হয়েছিল ‘তিন বন্ধু’। অসীম দত্ত। কলকাতা-৯২ |