প্রবন্ধ ১...
‘এখনি সাহেব সেজে রাখিব না ক্ষোভ’
য়লা বৈশাখ জাঁকিয়ে বসেছে আজকের বাঙালির পাঁজিতে, সে পি এম বাগচী, গুপ্তপ্রেস, শীল ব্রাদার্স বা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা, যা-খুশি তাই হতে পারে। যে-কোনও একটা খুললেই বুঝতে পারি যে চড়ক আর গাজনের গ্যানজাম চুকেবুকে যাবার পরেই ভোরবেলাতেই কৈলাসে বসে শিবঠাকুর নিত্যকালের নৈমিত্তিক কাজটি সেরে ফেলেছেন। বাঙালির হাতে পাঁজি মঙ্গলবার অন্তত সে রকমই জানাচ্ছে। ওই দিনই শিব পার্বতীকে কালতত্ত্ব বোঝান, বছরের জন্য গ্রহদের মধ্য থেকে রাজা ও মন্ত্রী ঠিক করে দেন আর আমাদের জন্য গড়গড় করে সম্বত্‌সরের শুভাশুভ ঘটনা আগাম জানিয়ে দেন। শিবই তো মহাকাল, তাই ক্ষণকাল তাঁর কণ্ঠস্থ। তিথি, বার, ক্ষণ ও লগ্নতে খণ্ড সময় ছোট ছোট করে ধরা পড়ে, নিত্য ভেঙে যায় অসংখ্য নৈমিত্তিকে।
এই সব ঘোর অবৈজ্ঞানিক পুরাণ কথা, কিন্তু সময়চিন্তাটি চিত্তাকর্ষক। জনইতিহাসে ও চৈতন্যে ব্যবহারিক ক্রিয়াকর্ম উদ্যাপনের দায়ই তো সময়ের রাজনীতি ও উপস্থাপনাকে জটিল করে তোলে। কবে থেকে বছর শুরু হবে বা হওয়া উচিত, এ নিয়ে সমাজে সমাজে সংস্কৃতি সংস্কৃতিতে ভেদ আছে। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি জানিয়েছেন যে, অতি প্রাচীন কালে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে উত্তরায়ণের আরম্ভ সময় থেকে বছর গোনা হত, বর্তমানের দোলযাত্রা ও হোলি সেই উত্‌সবেরই স্মৃতি বহন করছে। আজও উত্তরভারতে চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদে বর্ষারম্ভ হয়। সত্যি কথা বলতে কি, অষ্টাদশ শতকের বাঙালি কৃষকের জীবনে ফাল্গুন-চৈত্রের পুণ্যাহ ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ, কাছারিতে জমিদারের খাজনা তখনই মেটাতে হত। পৌষে হত ‘নবান্ন’, পিঠে-পুলির দিন, সেই দিনের মাহাত্ম্যে ঠাকুরমাদের রূপকথা ভরপুর। ‘বারমাস্যা’র বৈশাখ ঋতু তো খর বসন্ত, ‘সভে করে নিরামিষ’। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও চিন্তাহরণ চক্রবর্তী পয়লা বৈশাখে নববর্ষ উদ্যাপনের কোনও স্মার্ত প্রমাণ পাননি। প্রাক্ ঔপনিবেশিক বাঙালি কল্পনায় নতুন বৈশাখ মাস একেবারে সাদামাঠা আর ম্যাড়ম্যাড়ে।
বর্ষফল। ‘তিথি, বার, ক্ষণ ও লগ্নতে খণ্ড সময় ছোট ছোট করে ধরা পড়ে।’
উনিশ শতকে ছাপা বাংলা পাঁজির আদিপর্বেও পয়লা বৈশাখ নিয়ে কোনও কিছু পালনের আদিখ্যেতা নেই। অক্ষয় তৃতীয়ার গুণগান আছে, কারও কারও মতে ওই দিনই প্রজাপতি সৃষ্টির কাজ শুরু করেন। দোকানে দোকানে হালখাতার উত্‌সব ওই দিনই করা হত, তাই নিয়ে ছাপা ছবিও কখনও কখনও পাঁজির পাতায় দেখা যেত। বাংলা নববর্ষের উত্‌সব নিয়ে কোনও ছবিই উনিশ শতকের বাংলা ছাপা পাঁজিতে এতাবত্‌কাল চোখে পড়েনি, বরং চৈত্র সংক্রান্তির চড়কের ছবি বাংলা পাঁজির অপরিহার্য অঙ্গ ছিল।
১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা কমলালয়ের বাঙালি কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত স্পষ্ট জানাচ্ছেন, ‘খৃষ্টমতে নববর্ষ অতি মনোহর’, ‘বিলাতীয় শকে আসি করিল আশ্রম।’ নববর্ষের উদ্যাপনে সাহেবি ধুমধাম আর খানাপিনা দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, ‘শিবের কৈলাসখান আছে কতদূর, কোথা অমরাবতী আর কোথা স্বর্গপুর।’ সাহেবি সাধনা আর বাঙালি সাধের দোটানায় পড়ে কবি জানান, ‘পূরিবে সকল আশা ভেব নারে লোভ। এখনি সাহেব সেজে রাখিব না ক্ষোভ।’ এই ক্ষোভ মেটাতেই কি বাঙালি বাবুরা পয়লা বৈশাখকে পয়লা জানুয়ারির তৌলে জাঁকালো করে তুলেছিল? মনে পড়ে যে বিশ শতকের প্রারম্ভে দীনেন্দ্রকুমার রায় বাংলার পল্লিগ্রামে বাঙালির বারোমাসে তেরো পার্বণের অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। সেই তালিকাতেও পয়লা বৈশাখে নববত্‌সর উদ্যাপনের কোনও অনুষ্ঠানের উল্লেখমাত্র নেই। হাল আমলের পঞ্জিকার শাস্ত্রীয় নির্দেশগুলি একেবারে আধুনিক, ছাপা পাঁজির পাতাই সেইগুলির একমাত্র আকর।
তাই উনিশ শতকের শহুরে বাঙালির তৈরি করা সেকুলার উত্‌সব পয়লা বৈশাখ, শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান বা লৌকিক ব্রতের সম্পর্ক বিগর্হিত। অবশ্যই প্রেক্ষাপটটি সুন্দর। প্রাকৃত ভিখারি শিব ও ঘর-গেরস্থালীর চিরকেলে অন্নপূর্ণার পূজার মাস শেষ। যা দৈনন্দিন, যা তুচ্ছ, ঘরোয়া ও নৈমিত্তিক, তারই উদ্যাপন চলে চৈত্রে। ভক্ত্যাদের মানত শেষ হয়, ঢাক বেজে ওঠে, ‘ওই গাজনের বাদ্যি বাজা, কেই বা রাজা, কেই বা প্রজা।’ আর তার পরেই ফস করে পয়লা বৈশাখের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ি আরেক বছরের আবৃত্তিতে, নানা প্রত্যাশার ভরসায়, অপ্রত্যাশিতের প্রতীক্ষায় ও আশাভঙ্গের আশঙ্কায়।
নিত্য ও নৈমিত্তিকের জোড়েই চলে বাঙালির পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের পালা। তাঁর একদা সাড়া জাগানো বইয়ের সদ্য নতুন সংস্করণে ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, কী ভাবে জনসংস্কৃতিতে বার বার মার্গের আদর্শকে দেশি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে, সংস্কৃতির পর্বভাগ নিজস্ব ভঙ্গিতে করেছে। ওই চিন্তাকে প্রসারিত করে বলাই যায় যে, আমাদের সংস্কৃতিতেও অনেক অধুনাই পুরাণের রূপ ধরে হাজির হয়, হাল আমলের অনেক আচরণই পাঁজির মতো প্রকরণে ঢুকে পড়ে, সনাতনী ঐতিহ্যের আকার নেয়। উদযাপন তো ওই ঐতিহ্যকে দাগিয়ে তোলার জন্যই করা হয়।
কেবল কখন কোন পর্ব বা ক্ষণকে কী ভাবে দাগানো হবে, সেটাই আমাদের জন্য সময়কে অনুক্ষণ বানিয়ে তোলার রাজনীতি। ওই রাজনীতির জের ও জোরেই বছরে বছরে নিত্যের মধ্যে চলে নৈমিত্তিকের অভিষেক, সংস্কৃতির ভেতরে সংস্কার কাজ করে যায়।

ঋণ স্বীকার: ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়,
দ্য মেকিং অব আর্লি মিডিয়েভল ইন্ডিয়া। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.