রাজার ধর্ম কী? একটিই সুশাসন। রাজ্যের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, নাগরিকের মধ্যে আমরা-উহারা’র বিভাজন সৃষ্টি না করা যেমন সুশাসনের শর্ত, তেমনই ছোট ছোট, আপাত-তুচ্ছ বিষয়গুলির প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখাও সুশাসনের অঙ্গ। রাজ্যের বৃহত্তর প্রেক্ষিতে কোনও ঘটনা তেমন তাত্পর্যপূর্ণ নহে, অতএব তাহাকে অবহেলা করিলেও চলে এই মানসিকতাটি অতি বিপজ্জনক। কী বিপদ, তাহা পশ্চিমবঙ্গ হাড়ে-হাড়ে জানে। কলিকাতা ও শহরতলিতে ট্যাক্সি তেমনই একটি সমস্যা। শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় অবস্থানে প্রি-পেড ট্যাক্সি স্ট্যান্ড আছে। বিমানবন্দরে, রেল স্টেশনে অথবা অন্যত্র এই প্রি-পেড স্ট্যান্ডে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হইয়াছে, এমন ব্যক্তিমাত্রেই জানেন সে কী বিভীষিকা। বাম জমানাতে সিদ্ধান্ত হইয়াছিল, ইউনিয়নের লোকরাই সেই স্ট্যান্ড পরিচালনা করিবে। দলতন্ত্রই যাহাদের মোক্ষ, তাহাদের নিকট ভিন্ন কোনও সিদ্ধান্ত প্রত্যাশিতও নহে। তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসিবার দুই বত্সর পরেও সেই নিয়মই চলিতেছে। ইউনিয়নের লোক যাহাদের কোনও প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা নাই তাহারা যে বে-আইনের পথেই হাঁটিবে, তাহা এক প্রকার নিশ্চিত। মহানগরের প্রতিটি প্রি-পেড স্ট্যান্ডে সেই বে-আইনই দস্তুর। যাত্রীদের হয়রানি এত দিন প্রশাসনের নজরে পড়ে নাই। সম্প্রতি পরিবহণ দফতর সিদ্ধান্ত করিল, আর নহে। এই বার প্রি-পেড স্ট্যান্ড পরিচালনার দায়িত্ব পুলিশের হাতে তুলিয়া দেওয়া হইবে।
সিদ্ধান্তটি মন্দের ভাল। পুলিশ অন্তত প্রশাসনের অঙ্গ, কাগজে-কলমে দায়বদ্ধ। ইউনিয়ন যে ভাবে যথেচ্ছাচার করিত, পুলিশের পক্ষে ততখানি করা মুশকিল। কিন্তু পুলিশের হাতে দায়িত্ব তুলিয়া দিলেই সমস্ত অব্যবস্থা দূর হইবে, এই কথাটি শহরবাসীর কানে কিঞ্চিত্ নিষ্ঠুর রসিকতার ন্যায় ঠেকিবে। প্রশ্নটি পুলিশের হাতে দায়িত্ব তুলিয়া দেওয়ার নহে, প্রশ্নটি আসলে দায়বদ্ধতার। ট্যাক্সি স্ট্যান্ড পরিচালনার দায়িত্ব কোনও বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলিয়া দেওয়া যায়। সরকার তাহার উপর নজর রাখিবে। সেই সংস্থা সম্বন্ধে যাত্রীদের কোনও অভিযোগ থাকিলে তাহা যাহাতে বিনা হয়রানিতেই প্রশাসনের নজরে আনা যায়, সেই ব্যবস্থা করিতে হইবে। অভিযোগ উঠিলে তাহার নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা করিতে হইবে। অভিযোগ প্রমাণিত হইলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা বিধেয়। সুশাসন নিশ্চিত করিতে হইলে সরকারকেই সব কাজ করিতে হইবে, এই ধারণাটি ডায়নোসরের ন্যায় অধুনা বিলুপ্ত। সরকারের কাজ নিয়ন্ত্রণ। অন্যায় করিয়া পার পাইবার রাস্তাটি যদি প্রশস্ত থাকে, তবে কোনও চেষ্টাতেই সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে না। প্রশাসনের সব স্তরেই যাহাতে দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত হয়, অপরাধ করিলে শাস্তি যাহাতে নিশ্চিত হয়, সেই ব্যবস্থা করিতে হইবে। অনাচার যেমন একটি অভ্যাস, শৃঙ্খলাও তেমনই। বহু দিনের শাসনহীনতায় রাজ্যবাসী অনাচারে অভ্যস্ত হইয়াছেন। তাঁহাদের শাসনের পথে ফিরাইয়া আনিবার কাজটি কঠিন, অসম্ভব নহে। এক বার আইন মানিয়া চলা অভ্যাস হইয়া গেলে সেই অভ্যাস হইতে চ্যুত হওয়াও কঠিন হইবে। |