পাকিস্তানে রক্তের বান ডাকিয়াছে। একের পর এক রাজনৈতিক নেতার উপর নামিয়া আসিতেছে তালিবানের কালান্তক আঘাত। উত্তর পশ্চিম পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার মিঙ্গোরায় আওয়ামি ন্যাশনাল পার্টির নেতা মকরম শাহ যে-ই না গাড়িতে উঠিলেন, বোমা বিস্ফোরণে তত্ক্ষণাত্ তাঁহার প্রাণনাশ হইল। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার নির্বাচনী প্রার্থী মাসুম শাহ ও তিন সঙ্গী বোমার আঘাতে গুরুতর আহত। দুই দিন আগে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট দলের তালিবান-বিরোধী নেতা ফকরুল ইসলাম তালিবান বিস্ফোরণে নিহত। এই শেষোক্ত নেতা বিশেষ ভাবে তালিবান-বিরোধী বলিয়া পরিচিত ছিলেন, তালিবান প্রভাব দূর করিতে সচেষ্ট ছিলেন। অন্যদের ক্ষেত্রে এমনটা বলা যায় না: তাঁহারা তালিবান-শত্রু বলিয়া ব্যক্তিগত ভাবে চিহ্নিত ছিলেন না। অর্থাত্ আপাতত তালিবান নিশানায় মুড়ি-মিছরি বাছবিচার কম, প্রতি মুহূর্তের আতঙ্ক, কখন কোন পথে কাহার উপর তালিবানের আক্রমণ ধাইয়া আসে। জাতীয় নির্বাচনের দিন যতই আগাইয়া আসিতেছে, তালিবানের প্রচণ্ড রূপ প্রচণ্ডতর হইতেছে। পরিস্থিতি এমনই চলিতে থাকিলে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ধার্য নির্বাচন আদৌ সংঘটিত হইতে পারিবে কি না, তাহাই এক বিরাট প্রশ্ন। বাস্তবিক, এখনও পর্যন্ত ১১ মে নির্বাচনের দিন স্থির হইলেও প্রশাসনিক স্তরে প্রবল আশঙ্কা, শেষ পর্যন্ত এই দিনের মধ্যে দেশব্যাপী নির্বাচনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা যাইবে না। স্পষ্টতই তালিবানের নিশানায় এখন নির্বাচনী রাজনীতি ও দেশের বর্তমান ও আগামী জন-প্রতিনিধিরা: শাসক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি, তাহার শরিক দল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট এবং আওয়ামি ন্যাশনাল পার্টি, এবং বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এন) সকলের উপরই তাহাদের আক্রমণ বর্ষণরত।
পাকিস্তানে সর্বদা সর্ববিধ পরিস্থিতিতেই চক্রান্ত-তত্ত্বের বিশেষ রমরমা। এ বারেও ব্যতিক্রম নাই। নির্বাচনের আগেই সন্ত্রাসের এই নাটকীয় বাড়বাড়ন্ত দেখিয়া অনেকের মত, ইহা আসলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন সংঘটিত না হইতে দিবার গোপন ষড়যন্ত্র। এবং অবশ্যই, সেই ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা, পাক সেনা-কর্তৃপক্ষ। ইহা নেহাতই গুজব, এখনও পর্যন্ত বাস্তবপ্রমাণবিহীন। তবে এ কথা স্মরণে রাখা ভাল যে পাক সেনামহলের বিভিন্ন স্তরের সহিত জঙ্গি বাহিনীর সম্পর্ক এতই ঘনিষ্ঠ যে কোন গুজবে কতখানি সত্যের মিশেল, তাহার নির্ণয় অসম্ভব। হয়তো নির্বাচন একেবারে না ঘটিতে দেওয়ার পরিস্থিতি কোনও পক্ষেরই কাম্য নহে, নতুবা সদ্য যে নির্বাচিত সরকার তাহার মেয়াদ পূর্ণ করিল, তাহাকে হয়তো শেষ অবধি মেয়াদ-শেষের সময়সীমায় পৌঁছাইতেই দেওয়া হইত না। কিন্তু ইহা ঠিক যে এই ভয়ানক রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা যদি না থামে, তবে পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণতান্ত্রিক সরকার আসিয়া প্রথম হইতেই দুর্বল বোধ করিবে, এবং নিজের স্থিতির জন্য যথেষ্ট পরিমাণে রাওয়ালপিন্ডির কর্তৃপক্ষের মুখাপেক্ষী হইয়া থাকিবে।
একটিই রুপোলি রেখা: নির্বাচনের প্রাক্কালে পাকিস্তানের যাহা সবচেয়ে বেশি প্রত্যাশিত ছিল, সেই ভারতবিরোধী স্লোগানের প্রতিযোগিতা কিন্তু এ বার অনেক কম। দ্বিপাক্ষিক অশান্তি ও তিক্ততা বাড়িয়াছে বই কমে নাই, আফজল গুরুর ফাঁসি লইয়া পাক সরকার সতর্ক বার্তা দিলেও রাস্তার রাজনীতি তীব্র আকার ধারণ করিয়াছে। তবু নির্বাচন-রণরঙ্গে দিল্লির বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ বা ‘আজাদ কাশ্মীর’-এর স্লোগান উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। অনুপস্থিত জঙ্গি ইসলামের প্রতি পোষণ-তোষণের সরাসরি প্রয়াসও। ঘরোয়া পরিস্থিতি এতই সঙ্গিন যে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি মোটের উপর নিরাপদে এপ্রিল-মে মাস দুইটি কাটাইতে পারিলে বাঁচে। সন্ত্রাসী হামলারও যে একটি মঙ্গলময় দিক রহিয়াছে, পাকিস্তানের দিকে তাকাইয়া ভারত এই মুহূর্তে তাহা বুঝিতেছে। প্রধান দলগুলিও হয়তো অনুধাবন করিতেছে, এখন ভারতের সহিত শত্রুতা বাড়াইয়া নূতন সংকট তৈরির মূল্য বড় বেশি। গণতান্ত্রিক নির্বাচনই কালে-দিনে দুই প্রতিবেশী দেশের দূরত্ব কমাইবে, নির্ভরতা বাড়াইবে, উপমহাদেশের এই আশা অনেক দিনের। সংকট-দীর্ণ পথেও যদি তাহার দিকে এক পা অগ্রসর হওয়া যায়, উভয় তরফেই তাহা বিরাট লাভ। |