প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত এবং অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে এ বার প্রশাসনের উপরে চাপ তৈরি করল রাজ্য সরকারের তৈরি মেন্টর গ্রুপ।
প্রেসিডেন্সির ঘটনায় পুলিশ এখনও পর্যন্ত মোট পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে। ওই পাঁচ জনই ছাত্র এবং তারা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু অভিযুক্ত তৃণমূল কাউন্সিলর পার্থ বসু ও তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নেতা তমোঘ্ন ঘোষকে গ্রেফতার করা দূরে থাক, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি কলকাতা পুলিশ। ফলে তদন্তে পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। প্রেসিডেন্সির ওয়েবসাইটে সোমবার মেন্টর গ্রুপের তরফে প্রকাশিত এক বার্তায় এই ঘটনার নিরপেক্ষ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চেয়ে অবিলম্বে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবি তোলা হয়েছে।
নিরপেক্ষ তদন্ত বলতে কী বোঝাতে চেয়েছে মেন্টর গ্রুপ? মেন্টর গ্রুপের অন্যতম সদস্য, জাতীয় গ্রন্থাগারের অধিকর্তা স্বপন চক্রবর্তী বলেন, “আমরা চাই বিষয়টিকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে না দেখে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে দেখা হোক। কোনও পক্ষপাতিত্ব যেন না হয়।” |
হামলার দিন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটের সামনে। —ফাইল চিত্র |
তবে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে
ঘটনার পরে উপাচার্যকে ফোন করে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন, তার প্রশংসা করেছে মেন্টর গ্রুপ।
ওই ঘটনায় দোষীদের কাউকেই আড়াল করা হবে না বলে মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন। তার পরেও পুলিশ দুই তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার না করায় তৃণমূলের আরও কিছু নেতার দিকে আঙুল উঠছে। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় অবশ্য কোনও চাপের কথা মানতে চাননি। তিনি জানান, “প্রেসিডেন্সির বিষয়টি দেখছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়।” মুখ্যমন্ত্রীর নববর্ষের শুভেচ্ছা-বার্তা নিয়ে এ দিন পার্থবাবু রাজ্যপালের কাছে যান। সেখানেও দু’জনের মধ্যে আলোচনায় প্রেসিডেন্সি প্রসঙ্গ উঠেছে বলে রাজভবন সূত্রের খবর। পার্থবাবু এ দিন বলেন, “যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, প্রমাণ পেলে তাদের সবার বিরুদ্ধে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।” একই ভাবে তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন-ও সোমবার বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই ঘটনা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। তিনি ওই রকম ঐতিহ্যশালী কোনও প্রতিষ্ঠানে গুন্ডামি বরদাস্ত করবেন না। তৃণমূলের কেউ প্রেসিডেন্সির ঘটনায় যুক্ত থাকলে তাকেও রেয়াৎ করা হবে না।”
কিন্তু বাস্তবে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষিত হচ্ছে কি? প্রেসিডেন্সির স্নাতকোত্তর শাখার ছাত্র দেবর্ষি চক্রবর্তী জোড়াসাঁকো থানায় তৃণমূলের দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। শুধু তাই নয়, হামলার দিন টিভি চ্যানেলের ফুটেজে এবং ছবিতে দেখা গিয়েছে প্রেসিডেন্সির গেটের সামনে ছিলেন তৃণমূলের কাউন্সিলর পার্থ বসু এবং টিএমসিপি নেতা তমোঘ্ন ঘোষ। অথচ এখনও পর্যন্ত এক বারের জন্যও তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ। অথচ লিখিত কোনও অভিযোগ ছাড়াই প্রেসিডেন্সির দারোয়ান পাপ্পুকে জোড়াসাঁকো থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে দীর্ঘ সময় জেরা করা হয়েছে। তৃণমূলের ওই দুই নেতাকে তা হলে কেন জেরা করা হচ্ছে না? কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ কর্তা এ দিন বলেন, প্রেসিডেন্সি-কাণ্ডে যাঁদের নাম উঠেছে, তাঁদের সবাইকে জেরা করা হবে। গত ১০ এপ্রিল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর ও বাইরের ভিডিও ফুটেজ খুঁটিয়ে দেখে, আরও কয়েক জন প্রত্যক্ষদর্শীকে জেরা করে এবং ওই দু’জনের ছবি তাঁদের দেখানোর পরে তবেই পার্থ ও তমোঘ্নকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। পার্থ ও তমোঘ্নর সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদল্যায়ে তৃণমূল কর্মী ইউনিয়নের নেতা মন্মথ বিশ্বাস এবং টিএমসিপি-র আর এক নেতা তথাগত সাহাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন তদন্তকারীরা।
তদন্তকারীরা মনে করছেন, ওই দিন প্রেসিডেন্সির সামনে জড়ো হওয়া তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা দু’টি ভাগে বিভক্ত ছিল। একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে হামলা চালায়, অন্য অংশটি গেটের বাইরেই ছিল। পুলিশের বক্তব্য, যারা ভিতরে ঢুকে হামলা চালিয়েছে, তাদেরই চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হবে। এই ব্যাপারে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের কাছ থেকে ভিডিও ফুটেজ জোগাড় করছে পুলিশ।
তৃণমূল নেতাদের ব্যাপারে যখন ‘ধীরে চলো’ নীতি নেওয়া হচ্ছে, পাপ্পুকে পুলিশ কেন এত দ্রুত জিজ্ঞাসাবাদ করল? পুলিশের কাছে ব্যাখ্যা মেলেনি। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনীদের একটি অংশের অভিযোগ, পাপ্পুর নামে থানায় কোনও লিখিত অভিযোগ নেই। রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘটনার সঙ্গে পাপ্পুর নাম জড়িয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়ার জন্যই পুলিশ তাঁকে চটজলদি জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েছিল। এ দিনও প্রেসিডেন্সিতে গিয়ে পুলিশ পাপ্পুর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে। পাপ্পু কো-অর্ডিনেশন কমিটির সদস্য। তাই তাঁকে রাজনৈতিক ভাবে গোটা ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও প্রাক্তনীদের একাংশের অভিযোগ। প্রেসিডেন্সির ঘটনাটিকে রাজনৈতিক ভাবে দেখার জন্যই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অবকাশ থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন তাঁরা। মেন্টর গ্রুপের এ দিনের বিবৃতিও সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।
তবে মেন্টর গ্রুপ এ দিন আচার্য রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেসিডেন্সির উপাচার্য মালবিকা সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করেছে। তারা বলেছে, ‘‘যে ভাবে আচার্য রাজ্যপাল প্রেসিডেন্সিতে ছুটে গিয়েছেন এবং ছাত্রছাত্রীদের মনে সাহস জুগিয়েছেন তার তুলনা নেই। ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে প্রেসিডেন্সিকে তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প বলে উল্লেখ করে উপাচার্যকে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন, মেন্টর গ্রুপ তারও প্রংশসা করছে। আর উপাচার্য যে ভাবে গোটা পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন, তারও তুলনা হয় না। মেন্টর গ্রুপ সব সময়েই উপাচার্যের পাশে আছে।”
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার চৌহদ্দির নিরাপত্তা বাড়ানোর উপরেও জোর দিয়েছে মেন্টর গ্রুপ। তারা বলেছে, কলেজের ছাত্রছাত্রী, কর্মচারী ও শিক্ষকেরা তো বটেই বাইরের জ্ঞানী-গুণী মানুষ যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে ভয় না পান, তা সুনিশ্চিত করতে প্রেসিডেন্সির নিরাপত্তা নিয়ে সরব হয়েছেন প্রাক্তনীরাও। রবিবার প্রাক্তনী সংসদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কলেজ স্ট্রিটকে মিছিল-মুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে।
|
মেন্টর-কথা |
• নিরপেক্ষ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চাই
• হামলাকারীরা দ্রুত গ্রেফতার হোক
• ক্যাম্পাস ঘিরে থাকুক কড়া নিরাপত্তা
• ভয়মুক্ত পরিবেশ গড়ে উঠুক
• রাজ্যপাল, মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা ভাল
• উপাচার্যের উপরে পূর্ণ আস্থা রয়েছে |
আমরা চাই বিষয়টিকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে না দেখে আইনশৃঙ্খলার
সমস্যা হিসেবে দেখা
হোক। পক্ষপাতিত্ব যেন না হয়।
স্বপন চক্রবর্তী সদস্য, মেন্টর গ্রুপ |
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে,
প্রমাণ পেলে তাদের সবার বিরুদ্ধে
পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিল্পমন্ত্রী |
|