বিস্তীর্ণ দুর্বো ঘাসের এলোমেলো ঢেউ জমি। আশপাশে চা বাগানে ঘন সবুজের উপরে খেলা করছে রোদ। বিকেলের আলোয় জঙ্গল থেকে বুনো হাতির পাল হেলে-দুলে ঢুকে পড়ছে সেখানে। ভোরের শিশির মাড়িয়ে চলে যাওয়া চিতাবাঘের থাবার ছাপ এখনও ঘাসের বুকে স্পষ্ট। শতবর্ষের ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ব্রিটিশ সাহেবের বাংলো। আর তার হাতায় থমকে রয়েছে রোমাঞ্চ আর আভিজাত্যের এক মিশেল। এমনই দুটি ‘রয়্যাল’ গল্ফ কোর্সের হাত ধরে আন্তর্জাতিক পর্যটনের আঙিনায় নিজেদের নতুন মোড়কে তুলে ধরতে চাইছে লোহিত পারের রাজ্য, অসম।
অসম পর্যটন বিকাশ নিগমের অধিকর্তা অনুরাগ সিংহের মতে, অসম ভ্রমণ মানেই হয়ে দাঁড়িয়েছে অরণ্য-পর্যটন। সেই সঙ্গে খানিকটা কামাখ্যা। আরও একটু দূরগামীরা যেতেন মাজুলি। কিন্তু যে রাজ্যে আড়াই হাজার চা বাগান, সাড়ে আটশো টি-এস্টেট রয়েছে, আছে ২২টি গল্ফ কোর্স—সেখানে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সামনে চা ও গল্ফ পর্যটনকে অনায়াসে তুলে ধরা সম্ভব। তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পর্যটকদের নতুন স্বাদের কথা ভেবেই চা-বাগান মালিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। অধিকাংশ গল্ফ মাঠই চা-বাগানে। সে ক্ষেত্রে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। পর্যটকরা চা-বাগানের ইংরাজ আমলের বাংলোয় থাকতে পারবেন। সেই সঙ্গে খেলতে পারবেন গল্ফ। পাশাপাশি, থাকছে কাজিরাঙার অমোঘ আকর্ষণ। এই প্রকল্পের জন্য সরকারি-অসরকারি প্রতিষ্ঠানকে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা সে ব্যাপারে অনুঘটকের ভূমিকা নিচ্ছি।’’ |
নতুন এই প্রয়াসকে সফল করতে পর্যটন বিকাশ নিগম ও কাজিরাঙা গল্ফ রিসর্ট সংস্থা, যোরহাট জেলায় ‘কাজিরাঙা গল্ফ রিসর্ট অ্যান্ড গল্ফ কোর্স’ (কেজিআরজিসি) এবং প্রাচীন জিমখানা ক্লাবের গল্ফ কোর্স-কে আপাতত পাখির চোখ করেছে।
১৮৭৬ সালে ডি স্লিমনের হাতে গড়া জিমখানা ক্লাবের মাঠ মূলত ঘোড়দৌড় আর ‘নাইন হোল’ গল্ফ কোর্সের জন্য খ্যাত। এই গল্ফ কোর্স এশিয়ার প্রাচীনতম ও বিশ্বের তৃতীয় প্রাচীনতম। পাশাপাশি ১৯১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বি অ্যান্ড এ’ সংস্থার অধীনস্থ সাংসুয়া চা বাগানের ১৫০ একর জমিতে তৈরি হয়েছে ‘কেজিআরজিসি’। সম্প্রতি পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত চা-উৎপাদক হেমেন্দ্রপ্রসাদ বরুয়া দেশ-বিদেশের ধনী, অভিজাত পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য এই প্রকল্প হাতে নেন। ২০১১ সালের নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ এই গল্ফ কোর্সের উদ্ধোধন করেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও গল্ফপ্রেমী। তাঁর মতে, সঠিক পরিকল্পনা ও বিপণনের অভাবেই রাজ্যের গল্ফ পর্যটনকে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা যায়নি। যোরহাট, ডিগবয়কে কেন্দ্র করে পর্যটনশিল্পকে নতুন ভাবে ঢেলে সাজা প্রয়োজন। কেজিআরের প্রচার ও বিপণন সচিব পল্লব বরুয়া জানান, সাংসুয়া চা বাগানের ভিতরে তৈরি করা হয়েছে ‘এইট্টিন হোল’-এর ৭১ পার গল্ফ কোর্স। মাঠের বুকে বাঙ্কার, জলাশয়, ঢিপি, ঢাল, ঢেউ খেলানো জমি ও পাহাড় রয়েছে। কেজিআরের দাবি, সে দিক থেকে এটি উত্তর-পূর্ব তথা পূর্বের সবচেয়ে ‘চ্যালেঞ্জিং’ গল্ফ কোর্স। মূল গল্ফ কোর্সটি বিদেশি ঘাসে ঢাকা। ‘ফেয়ারওয়ে’ ঢাকা দুর্বো ঘাসে। জমির তলা দিয়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে সাজানো হয়েছে নিকাশি নালা। এ মাঠের বুক চিরে চলে যায় চিতাবাঘ। চা বাগানের ভিতরে ঢুকে আসে বুনো হাতির পাল। আর রয়েছে গল্ফ অ্যাকাডেমি। |
প্রকৃতি ও আধুনিকতার পাশাপাশি ‘বুড়া সাহেব’-এর বিখ্যাত বাংলোর ঐতিহ্য সাংসুয়ার ‘ইউএসপি’। ১৯০০-১৯০৫ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ম্যানেজার এই রাজকীয় বাংলোটি তৈরি করান। স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি ‘বুড়া সাহিব’ নামেই পরিচিত ছিলেন। বাংলোর ভিতর ছিল তাঁর নিজস্ব পুকুর। গল্ফের মাঠের সঙ্গেই ‘বুড়া সাহিব বাংলো’-কে ক্লাব হাউস তৈরির পরিকল্পনা করেছেন বরুয়া। ভিতরে তৈরি হয়েছে সুইমিং পুল, গ্রন্থাগার, পুল, আধুনিক জিম, স্পা। অতিথিদের জন্য বুড়া সাহিবের বাংলোয় ২৩টি এবং ১৫ মিনিট দূরত্বের মিস্ত্রি সাহিবের বাংলো ‘ঠ্যাঙ্গাল ম্যানর’ ও ‘বেনিয়ান গ্রোভ’ মিলিয়ে ১২টি ঘর রয়েছে। ভাড়া ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা।
রাজ্য পর্যটন দফতরের আশা, কাজিরাঙা ও যোরহাটের দূরত্ব যেহেতু বেশি নয় তাই আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য একসঙ্গে কাজিরাঙা, যোরহাটের অরণ্য-পর্যটন, মাজুলি দ্বীপ ভ্রমণ, সত্র-পর্যটন, চা-পর্যটন, গল্ফ-পর্যটনকে এক সূত্রে গেঁথে ফেলা সম্ভব।
কেবল যোরহাটই নয়, তৈলনগরী ডিগবয়ের এইট্টিন হোল গল্ফ কোর্স ও সংলগ্ন ক্লাবহাউস-বার-সুইমিং পুল, রেস্তোঁরা ইতিমধ্যেই পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়। গুয়াহাটি আসা পর্যটকদের জন্য শহরের অদূরে, চন্দ্রপুর-সোনাপুর এলাকাতেও নতুন একটি গল্ফ রিসর্ট গড়ার কথা ভাবছে পর্যটন দফতর।
|