কে কাকে উসকে দিল, কোন মারের পিছনে আগের কোন মার কারণ হিসেবে বহাল,
শুধু তার খোঁজ। মারের বদলা মার।
আরও একটা বছর এই করেই কাটিয়ে দিলাম।
এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্তির উপায় কী? বাংলা লোককথায় উত্তর খুঁজেছেন বিশ্বজিৎ রায় |
নতুন বাংলা বছরে মাঝে মাঝে পুরনো কথা পড়তে ভাবতে ইচ্ছে করে। বঙ্গদেশের মুখে মুখে চলে আসা লোকায়ত গপ্পের সংকলক ও লেখক দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার। তিনি রবিঠাকুরের সার্টিফিকেট ধন্য। “ঠাকুরমার ঝুলিটির মত এত বড় স্বদেশী জিনিস আমাদের দেশে আর কি আছে?
ঠাকুরমার ঝুলি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি বই লিখেছিলেন তিনি। মিত্রমজুমদার মশাইয়ের বই দাদামশায়ের থলে-তে সেই চেনা গপ্পখানা আছে “বাংলার রসকথা”। হবুচন্দ্র রাজা গবুচন্দ্র মন্ত্রী। হবুরাজার দেশে সন্ন্যাসীর পেটুক শিষ্য এসে দেখল, “মুড়ি মিশ্রি ক্ষীর ছানা রসগোল্লা সব সমান!” ভাবল “নিশ্চয় স্বর্গ!” গুরু সাবধান করলেন “ মুড়ি মিশ্রির সমান দর। এ নিশ্চয় কোন মূর্খের দেশ...” শিষ্য শুনলে না। সেই সাম্যের দেশেই থেকে গেল। এক দিন সিঁদ কাটতে গিয়ে দেশে এক চোরের মৃত্যু হল। রাজা কোতোয়ালকে তলব করলেন। কেন মারা গেল? অবিলম্বে জবাব চাই। নইলে শূলদণ্ড। কোতোয়াল বাঁচতে দোষ চাপাল যার বাড়ির দেওয়াল তার ওপর। ডাকাও গেরস্তকে। গর্দান যায় দেখে গৃহস্থ দোষ দিল মালিকে, পাঁচিল তো সেই তুলেছিল। পাইক দেখে মালি তো ভ্যাবাচ্যাকা মাটি যে ছেনেছে তার ঘাড়ে দোষ দিয়ে কোনও ক্রমে প্রাণ বাঁচাল সে। সুতরাং ডাক পড়ল মালির মামাতো ভাইয়ের পিসতুতো ভাইয়ের মাটি তো সেই ছেনেছিল। সে দেখিয়ে দিল কুমোরকে কুমোরের কলসি নাকি ছিল ফুটো। সেই ফুটো দিয়ে জল এসে মাটি নরম করে দিয়েছে, গাঁথনি পাকা হয়নি, পাঁচিল পড়েছে, চোর মরেছে। অতঃপর কুমোরের তলব। কুমোর দেখল বাঁচতে হলে দোষী খুঁজতে হবে। সে বলল দোষ তার নয়, দোষ কাঠের। কাঠের খোঁচা লেগে কলসি পোড়ার সময় ফুটো হয়, জল পড়ে, মাটি ভেজে। কাঠ দিত কাঠকুড়ানি বুড়ি। বুড়ি বলল সে তো কাঠ বেচে কাঠুরের। শুকনো কলাপাতার মতো কাঠুরেকে কিছু বোঝার আগেই চাপানোর ব্যবস্থা হল শূলে। কিন্তু সেই সাম্যের দেশে কাঠুরের শরীরে চড়ুই পাখির মাংসও গায়ে ছিল না। |
‘দাও বেটাকে শূলে’। দাদামশায়ের থলে, দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার |
শূল তো বিঁধল না ফলে খোঁজ পড়ল এমন শরীরের যাতে মাংস আছে। বিঁধবে ভাল শূল, বিচার হবে ন্যায়নিষ্ঠ। গপ্পে কী হল তার পর সে কথা থাক। এতখানি পড়ে মনে হল হবুরাজার দেশে ন্যায় মানে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো চাঁদমারি হিসেবে কাউকে খুঁজে বের করা। এটার জন্য এটা হল কোনও ক্রমে শনাক্ত করা চাই। তলিয়ে ভাবা নিষেধ। এ পদ্ধতি যে কেবল হবুরাজার দেশে অনুসরণ করা হত তা-ও নয়। সেই নেকড়ে আর ভেড়ার গপ্পখানা মনে নেই! নেকড়ে ভেড়াকে বলল, “তুই জল ঘোলা করেছিস?” ভেড়া বলল, “না।” নেকড়ে তো দোষ চাপাবেই। বলল, “তোর পূর্বপুরুষ করেছে”। বলে দোষী ভেড়াকে খেয়ে ফেলল। এও তো একই পদ্ধতি। চাঁদমারি হিসেবে, টার্গেট হিসেবে কাউকে ঠিক করে নেওয়ার জন্য হিংসাকে ন্যায্য বলে প্রচার করার
জন্য কার্য-কারণের বিচিত্র পরম্পরা তৈরি
করা। সমস্যার মূলে না গিয়ে ন্যায়বিচার প্রদর্শনের ভান।
মনটা অনেক নাগরিকেরই বিষণ্ণ এখন। কে কাকে উসকে দিল, কোন মারের পিছনে আগের কোন মার কারণ হিসেবে বহাল শুধু তার খোঁজ। মারের বদলা মার। মূল সমস্যা নিয়ে কোনও পক্ষই ভাবেন না। নতুন বছরে নাগরিকদের কি এর থেকে রেহাই মিলবে না? বাংলার চিরকেলে রসকথা তো লোকায়ত কাণ্ডজ্ঞানের ভাণ্ডার। এটার জন্য এটা, এই হিংসের জন্য এই হিংসে, এই মারের জন্য এই মারের চক্র থেকে বাইরে আসার চেষ্টা যে করা উচিত সেটাই তো সেই লোকায়তরা বলতে চেয়েছিলেন। হবু রাজার দেশ থেকে শিষ্যকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন গুরু। আমাদের পালানোর উপায় নেই। কাজেই না পালিয়ে মোকাবিলা করতে হবে। দোষ খুঁজে হিংসার চক্রকে বহাল রাখার রাজনীতি আর যা-ই হোক, ভাল রাজনীতি নয়। নাগরিকরা তা চান না। এ কথাটা স্পষ্ট করে বলা দরকার। অনেক বিপ্লব আর পরিবর্তনের পর এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু আমরা যেন না হারাই।
|
লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |