পরিবর্তন শব্দটি বহুব্যবহারে জীর্ণ, তবে নববর্ষের প্রভাতে তাহাকে স্মরণ করিলে অন্যায় হইবে না। বিশেষত যখন নিছক স্লোগান বা বিজ্ঞাপন হইতে তাহাকে বাস্তবে পরিণত করিবার একটি সঙ্কেত সম্প্রতি দেখা যাইতেছে। সঙ্কেত এখনও ক্ষীণ ও অনিশ্চিত, কিন্তু সকল আশাই যাহার হারাইয়াছে তাহার পক্ষে অল্পই বিস্তর। বাঙালি জানে, নেই-মামা অপেক্ষা ক্ষীণ-মামা ভাল। এবং ইহাও তাৎপর্যপূর্ণ যে, সুসঙ্কেতটি আসিতেছে প্রশাসনের সর্বোচ্চ আসন হইতে। মুখ্যমন্ত্রী যখন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নিকট সাম্প্রতিক ঘটনাবলির জন্য খেদ জানান এবং এই প্রতিষ্ঠানের গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখিতে সর্বশক্তি প্রয়োগের আশ্বাস দেন, তাহার সঙ্কেত-মূল্য অনস্বীকার্য। সেই প্রতিজ্ঞার সূত্র ধরিয়াই তিনি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ও স্থিতি ফিরাইবার অঙ্গীকার করিয়াছেন, দল বিচার না করিয়া শান্তিভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা লইবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন, এমনকী সে জন্য সর্বদলীয় উদ্যোগের প্রস্তাবও পেশ করিয়াছেন। অনেক আগেই এই উদ্যোগ তাঁহার করা উচিত ছিল। কেবল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ব্যতিক্রমী উপলক্ষে নয়, সামগ্রিক ভাবেই রাজ্যের অশান্ত পরিসরে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠিয়া রাজধর্ম পালনে আগাগোড়া আপসহীন থাকা তাঁহার কর্তব্য ছিল। তবু, বিলম্বে হইলেও তাঁহার এই শুভবোধ স্বাগত।
রাজনীতিকরা অনেক সময়েই বিপাকে পড়িলে সুবাক্য বলিয়া থাকেন, বিপাক কাটিলে তাহা দিব্য ভুলিয়া যান। প্রেসিডেন্সির দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়া গিয়াছে বলিয়াই মুখ্যমন্ত্রী এখন শান্তির কথা বলিতেছেন, অচিরে ভুলিয়া যাইবেন এমন ধারণাকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া কঠিন। কিন্তু শুভনাস্তিকতা একটি কানাগলি ‘কিছুই হইবে না’ বলিয়া হাল ছাড়িয়া রাখিলে সত্যই পশ্চিমবঙ্গের কিছুই হইবে না। সুতরাং নিতান্ত শুভবুদ্ধির যুক্তিতেই মুখ্যমন্ত্রীর কথাগুলিকে আত্মশুদ্ধির আন্তরিক বার্তা হিসাবে গ্রহণ করিবার কারণ আছে। গাঁধীজির প্রসিদ্ধ উক্তি স্মরণীয়: যে পরিবর্তন আনিতে চাহো, নিজে সেই পরিবর্তন হও। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল ও সরকারের সর্বাধিনায়িকা যদি সত্যই সেই উক্তি অনুসরণের চেষ্টা করেন, তবে এখনও আশা আছে।
এই আশাকে যদি চরিতার্থ করিতে হয়, পরিবর্তনের সঙ্কেতকে যদি ফলপ্রসূ করিয়া তুলিতে হয়, তবে প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই পালন করিতে হইবে। তাঁহাকে সর্বাগ্রে দেখিতে এবং দেখাইতে হইবে, তিনি যাহা বলিতেছেন তাঁহার দল এবং সরকার তাহা মানিয়া চলিতে প্রস্তুত। বিশেষত, গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন তাঁহার সহকর্মীরা যদি তাঁহার এই উত্তরণের আন্তরিক শরিক হন, তবে সঙ্কেতের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ে, ১৪২০ বঙ্গাব্দের পশ্চিমবঙ্গ ১৪১৯ অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক ভরসায় বুক বাঁধিতে পারে। গভীর উদ্বেগের কথা, লক্ষণ তাহার বিপরীত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন সম্মুখে চলিবার আহ্বান জানাইতেছেন, তাঁহার বিবিধ প্রবীণ সহনায়ক তখন সেই পুরানো বৃত্তেই ঘুরিয়া চলিয়াছেন। দুইটি দৃষ্টান্ত: পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁহার নেত্রীর ফেলিয়া আসা ‘সাজানো’ তত্ত্বের ধ্বজা তুলিয়া আস্ফালন করিতেছেন, সৌগত রায় প্রেসিডেন্সির উপাচার্যের নিন্দা করিতেছেন। তাঁহাদের এই আচরণ স্পষ্টতই দলনেত্রীর ঘোষিত নীতির বিপরীত। সুতরাং তাঁহারা সচেতন ভাবে বা অচেতন ভাবে, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করিয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য, এই আচরণের জন্য তাঁহাদের শাস্তিদান। মন্ত্রিসভা হইতে তাঁহাদের বিদায় জানানোই হয়তো এ ক্ষেত্রে যথার্থ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, কিন্তু তাহা যদি সম্ভব না-ও হয়, অন্তত তাঁহাদের প্রকাশ্যে কঠোর তিরস্কার করা তাঁহার ন্যূনতম দায়িত্ব। তাহা না হইলে এই সংশয় জাগিবেই যে, মুখ্যমন্ত্রী নিজের ভাবমূর্তি পালিশ করিবার জন্য এক রকম বলিবেন আর দলীয় বাহিনীকে চাঙ্গা রাখিতে দলের অন্য নেতাদের দিয়া অন্য রকম বলাইবেন, ইহাই তাঁহার প্রকৃত নীতি। বিশ্বাসযোগ্যতা এক বার হারাইলে তাহা পুনরুদ্ধার করা সতত কঠিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই পুনরুদ্ধারের একটি সুযোগ নিজেই তৈয়ারি করিয়াছেন। ক্ষুদ্র রাজনীতি বা দলীয় বিশৃঙ্খলা, কোনও কারণেই সেই সুযোগ নষ্ট করা তাঁহার উচিত নয়। তাঁহাকেই আপন শুভেচ্ছা প্রমাণ করিতে হইবে। |