বিনোদন
মঙ্গলযাত্রীকে আনন্দ-অভিবাদন
ঙ্গলকাব্যের ধনপতি পারেনি। তার জলযাত্রা ব্যর্থ হয়েছিল। সাতটির মধ্যে ছয়টি ডিঙাই ডুবে গিয়েছিল, বারো বছর কারাবাস করতে হয়েছিল।
উপন্যাসের ধনপতি পারল। দুই স্ত্রী লহনা ও খুল্লনাকে নিয়েই সে উঠে এল স্মৃতির জলতল থেকে, অশন ব্যসন মনন সব কিছু নিয়ে। রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’ তাই ১৪১৯ সালের আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত।
আধুনিক বাংলা সাহিত্য নানা ভাবে মঙ্গলকাব্যের মোকাবিলা করতে চেয়েছে। মনে পড়ে শম্ভু মিত্রের বাচনে উজ্জ্বল ‘চাঁদ বণিকের পালা’: ‘তল নাই? পাড়ি দেও।’ অমিয়ভূষণ মজুমদার লিখেছিলেন ‘চাঁদবেনে’ উপন্যাস। সেখানে মনসা নেই, শুধু উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে চাঁদ সদাগরের বোঝাপড়া। বাংলাদেশেও সেলিনা হোসেন ‘চাঁদবেণে’ নামে লিখেছিলেন উপন্যাস। চম্পাইগঞ্জ গ্রামের জমিদারকে খুন করে খেতমজুর চাঁদ। সঙ্গিনী সাকিনার গর্ভে তখন তার সন্তান, এ যুগের লখিন্দর।
দুই বাংলার এই সাহিত্য-মানচিত্রে রামকুমার একক অভিযাত্রী। তিনি মঙ্গলকাব্যের কোনও পুনর্ব্যাখ্যায় নেই। বরং বাংলা ভাষায় হারিয়ে-যাওয়া শব্দগুলি দিয়েই তৈরি করে নেন অন্য রকম ভাষা: ‘সাঁঝের শ্রীকালি চলে সতর্ক পদে। ক্ষেমংকরী ডানা গুটিয়ে বসে বটবৃক্ষের ডালে।’ আধুনিক পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের শেষে শব্দার্থতালিকায় লেখক জানিয়ে দিয়েছেন, শ্রীকালি মানে শিয়াল। ক্ষেমংকরী = শঙ্খচিল। জয়দেবের গীতগোবিন্দে শিয়ালকে হ্রীকালি বলা হয়েছিল।
সাহিত্য অকাদেমির (পূর্বাঞ্চল) প্রাক্তন সম্পাদক রামকুমার পাঁচ বছর ধরে চণ্ডীমঙ্গলের এই উপাখ্যান নতুন করে লিখেছেন। সেই সময়পর্বের বড় অংশ ব্যয় হয়েছে এই শব্দগুলির খোঁজে। ‘‘লিখতে লিখতে আতঙ্কিত হয়েছি একটা কথা ভেবে। আমরা কোহিনূর ফিরে আসবে কি না, তা নিয়ে গলা ফাটাই। অথচ, এই শব্দগুলির জন্য কোনও বেদনা অনুভব করলাম না? তাদের মৃত্যুও বিস্মরণে চলে গেল?’’
শুধু হারিয়ে-যাওয়া শব্দ নয়। উপন্যাস তুলে এনেছে আরও বেশি কিছু। ‘শুকুতার বড়ি হবে কুলত্থ কিংবা মাষকলাইয়ে। নট্যা শাকে ফুলবড়ি। কাতলার মীন-মরিচ ঝোলে চণকের বড়ি।’ জিভে জল আসে। রামকুমার মনে করিয়ে দিলেন, বাঙালি রান্না মানে শুধু অর্বাচীন ডাব-চিংড়ি বা ভেটকি-পাতুরি নয়। লেখক-পরিচিতিতে প্রিয় খাদ্য ‘বদরী শকুল’। কুল দিয়ে শোলমাছের টককে মঙ্গলকাব্যে ওই নামেই ডাকা হত।
পরিচিতি বইয়ের শেষে। শুরুতে, রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রচ্ছদ এঁকেছেন রঙিন পটের ধাঁচে। ২৪০ পৃষ্ঠার বইয়ে একমাত্র প্রিন্টার্স পেজ-এ ‘পাবলিশ্ড বাই...’ ইত্যাদি ছাড়া কোনও ইংরেজি শব্দ নেই। ভাষা থেকে প্রচ্ছদ-অঙ্গসজ্জা, সবেতে প্রাক্-ঔপনিবেশিক বাংলা।
এবং নদনদীর ঊর্মিমুখর উপস্থিতি। দেবী চণ্ডীর আহ্বানে গঙ্গায় যাবতীয় নদী চলে আসে। রূপনারায়ণ, দামোদর, শিলাই, কাঁসাই, অজয়, মহানন্দা। ‘‘উপনিবেশের আগে গঙ্গার স্রোতে, তার দুই ধারের জনপদে এত বৈচিত্র্য ছিল, আমরা ভাবি না। গঙ্গা বলতেই যেন জোব চার্নকের নদী। নইলে গঙ্গার সৌন্দর্যায়নে টেম্স কখনও মানদণ্ড হয়?’’ প্রশ্ন লেখকের।
ঔপনিবেশিক বয়ানকে নানা ভাবেই তছনছ করেছে এই উপন্যাস! ধনপতি উপাখ্যানের মূল বিন্দু কোথায়? সমুদ্রে ভেসে-থাকা ‘কমলে কামিনী’ মূর্তি। পদ্মের উপর সুন্দরী নারীর বেশে চণ্ডী, এক হাতে হাতি ধরে গিলছেন। পরক্ষণে উগরে দিচ্ছেন। আধুনিকতার দীপ্ত দ্বিপ্রহরে এই ‘অদ্ভুত সৌন্দর্য’ বাঙালি মেনে নিতে পারেনি, মনে হয়েছিল, গাঁজাখুরি। ‘র্যাশনালিটি’র অগম্য।
অথচ সে কালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ‘কমলে কামিনী’ বাতিল করে দেননি, সনেট লিখেছেন ‘বঙ্গ-হ্রদ-হৃদে চণ্ডী কমলে কামিনী।’ যুক্তিবোধের একমাত্রিক বয়ান নয়, বাঙালি তখন বিকল্প সম্ভাবনাতেও বিশ্বাস রাখত। কমলে কামিনীই সেই বিকল্প। তিনটি স্তর আছে তার। প্রথম, দৈবী মায়া। ধনপতিকে শাস্তি দিতে দেবী অদ্ভুত রূপ ধরেছেন। দ্বিতীয়, দৃষ্টিবিভ্রম। ধনপতি ছাড়া আর কেউ মূর্তি দেখতে পায় না। তৃতীয় স্তরে, যৌনতা। এত দিনের সমুদ্রযাত্রায় জোটেনি নারীশরীর। ফলে, কমলে কামিনী দেখে ধনপতি মদনতাড়িত। পুজো পেতে চণ্ডী যৌন কামনাও উস্কে দেন। উপন্যাসে ধনপতি দেবীকে বলে, ‘নয়নাভিরাম কুচগিরি, নিবিড় নিতম্ব। এ রূপ পূজ্য হবে কেমনে?’
ধনপতির কাহিনি নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী একদা ‘বেনেবউ’ উপন্যাস লিখেছিলেন। তিনিও আজ আপ্লুত, ‘গত দশ-বারো বছরে অন্যতম সেরা উপন্যাস।’ উপন্যাসের প্রকরণে রামকুমার অবশ্য কয়েক বছর ধরেই বাঙালিকে মুগ্ধ করে আসছেন। কে ভুলতে পারে ‘ভবদীয় নঙ্গরচন্দ্র’? প্রিয়ঙ্কা বঢরার ছেলেই হবে বলে সাংবাদিক বৈঠক, খবরটি ছেপেও বেরিয়েছে। গ্রামের চাষি নঙ্গরচন্দ্র প্রিয়ঙ্কার উদ্দেশে চিঠি পাঠায়, ‘তোমার ঠাকুমা থাকলে আজ তার বড় আনন্দ হত।... বলদ না গাই, তা নিয়ে তুমি ভাববে কেনে।’ প্রান্ত থেকে ক্ষমতার দিকে তির নিক্ষেপই তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর ‘দুখে কেওড়া’ কাঁচির (চোলাই) আড্ডায় বলে, ‘বই ভাল জিনিস, তবে কথাগুলো ত্যাড়চা। জমিকে বলে ভূমি, চাষকে কৃষি!’
বাঁকুড়ার গেরিয়া গ্রামের ছেলে রামকুমার বাস্তবেও দুখে কেওড়াদের চেনেন। ‘‘আমাদের গ্রামে ফটিকরা তিন ভাই ছিল। তাদের পাশেই দুখের বাড়ি। ফটিক আমার বন্ধু, ওরা তিন ভাই ডাকাত ছিল। তিন জনই ডাকাতি করতে গিয়ে মারা যায়।’’ ডাকাত আপনার বন্ধু ছিল? নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের প্রাক্তন শিক্ষক প্রশ্নটা উড়িয়ে দিলেন, ‘‘আরে, রোজ ডাকাতি করত নাকি? ধান কাটার পর যখন হাতে কাজ থাকত না, বেরোত।’’
গ্রামের ডাকাত, চুল্লুখোরদের সঙ্গে এ ভাবে মিশে যাওয়াটা অকাদেমির সম্পাদক জীবনে কাজেও দিয়েছিল। ললিতকলা বা অন্য সরকারি সংস্থা তখন মিজোরাম, মেঘালয়ে নিয়মিত অধিবেশন করতে পারত না। কিন্তু সাহিত্য অকাদেমির বেলায় অন্য ঘটনা। “ওখানে জঙ্গিরা বাজেটের দশ শতাংশ দাবি করত। ফলে দশ লাখ টাকা বাজেটের আন্তর্জাতিক সম্মেলন কখনও ডাকতাম না। এক লাখ টাকার দশটা সম্মেলন। দশ হাজারের জন্য ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করবে কে?”
কে বলে, মঙ্গলকাব্য শুধু সাহিত্যের নীরক্ত পাঠ্যসূচি? একুশ শতকের বাঙালির সঙ্গে তার সেতু গড়ে দিল ‘ধনপতির সিংহলযাত্রা’। সেই মেধাবী সেতুবন্ধনকেই এ বারের আনন্দ-শ্রদ্ধার্ঘ্য।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.