বাবা জ্ঞান দিয়োনা |
বং কানেকশন |
স্ত্রী-রা বাঙালি। তাই বিবাহসূত্রে বাঙালিয়ানাটা বেশ ভালই রপ্ত
করেছেন এঁরা। কী ভাবে? জানাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
জন্মসূত্রে এঁরা কেউ বাঙালি নন। তবে বিয়ের পর এঁদের অনেকের মধ্যেই বাঙালিয়ানার ছোঁয়া এসে গিয়েছে অচিরেই। কেউ সর্ষে ইলিশ পছন্দ করেন, তো কেউ ভালবাসেন ছবি বিশ্বাসের সিনেমা। আবার আবেগপ্রবণ বাঙালির দোষ ত্রুটি নিয়ে ঠাট্টা করতেও ছাড়েন না তাঁরা। ম্যাডলি বাঙালি না হলেও এঁদের বং কানেকশনটা আজ বেশ মজবুত। নববর্ষে এঁদের বাঙালিয়ানার টুকিটাকি খোঁজ দিচ্ছে আনন্দplus
|
ইরফান (অভিনেতা)
কাটোয়ার ডাঁটাও ভালবাসেন
|
|
|
সুতপা শিকদার |
ইরফান বাংলা ছবি দেখে। আজকাল অনেক বেশি অভিনেতাদের চেনে। ও ছবি বিশ্বাসের বড় ফ্যান। পাহাড়ি সান্যালের সিনেমাও পছন্দ |
|
অভিনেতা ইরফান বিয়ে করেছেন তাঁর ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার সহপাঠিনী সুতপা শিকদারকে। সুতপা চিত্রনাট্য লেখেন। দিল্লির বাঙালি। বেশ কয়েক বছর ইরফান আর সুতপা লিভ-ইন করার পর বিয়ে করেন। এখন দু’জনেই থাকেন মুম্বইতে। আর ইরফানের বাঙালিয়ানা? “ও তো আজকাল কাটোয়ার ডাঁটাও খায়। পালং শাকের ঘণ্ট আমাদের বাড়িতে রান্না হয়। এ ছাড়াও পাঁচমিশেলি তরকারিটাও খায় ইরফান। আলুপোস্ত খায় না কারণ আলুটা ও বেশি পছন্দ করে না,” সুতপা জানান। আর মাছ? ইরফান রাজস্থানের মানুষ। ওখানকার মাছ রান্নার ধরনটা বেশ আলাদা। আজকাল অবশ্য বাঙালিদের মতো সর্ষে দিয়ে মাছ ভালবাসে।
বাংলা সিনেমা দেখেন? “এনএসডিতে থাকাকালীন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহের ছবি দেখেছে। জানি না, আমি এটার জন্য কতটা ক্রেডিট নিতে পারব। তবে এ কথা ঠিক যে, ইরফান আজকাল অনেক বাঙালি অভিনেতাকে চেনে। এটা হয়তো আমার সংস্পর্শে থেকেই হয়েছে। ও ছবি বিশ্বাসের বড় ফ্যান। পাহাড়ি সান্যালের সিনেমা পছন্দ করে,” সুতপা জানান।
আর পছন্দ বাংলাদেশি গায়ক অর্ণবের গান। “আমি কিছু বাংলাদেশি লোকগীতির গায়কদের গান খুঁজছিলাম। সেটা করতে গিয়ে অর্ণবের গানটা শুনি। অসাধারণ লাগে। বেশ মনে আছে আমরা তখন নিউ ইয়র্কে ছিলাম। ইরফান একটা বিদেশি টেলিভিশন সিরিজ ‘ইন ট্রিটমেন্ট’-এর শু্যটিংয়ের জন্য কাজ করছিল। সেখানে ওর চরিত্রটা আবার এক বাঙালির। ইরফানকে দেখি এক দিন অন্তত দশ বার পর পর ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না’ গানটি শুনতে,” সুতপা জানান।
টানা কুড়ি দিন নিউ ইয়র্কে রোজ সকালে উঠে অর্ণবের এই গানটা ইরফান শুনতেন। অর্ণবের ব্যান্ডের গানের থেকে ওর রবীন্দ্রসঙ্গীতটা ইরফান বেশি পছন্দ করেন।
তবে বাংলা ভাষাতে এখনও বেশি সড়গড় নন তিনি। “বুঝতে পারে। আমরা যদি ওর সামনে হেসে হেসে ওকে নিয়ে বাংলাতে কোনও ইয়ার্কি করি, ও সেটা বুঝতে পারে,” বলে হেসে ফেলেন সুতপা।
আর তার পর বলেন, “বাঙালি মেয়েদের ওর বেশ পছন্দ। সেক্সি, ডাস্কি লুক ইরফান পছন্দ করে। ওর শুধু একটাই আক্ষেপ। বাঙালি মেয়েরা এত সোনা কেন পরে? কোনও অনুষ্ঠানে গেলে ও আমাকে আগে বলে বাঙালিদের মতো অত সোনা পরে যেও না কিন্তু!”
|
সৌরভ শুক্ল (অভিনেতা)
পয়লা বৈশাখে চাই লুচি আর কষা মাংস
|
|
|
বর্ণালি রায়-শুক্ল |
আগে সৌরভের বাংলা মানে ছিল ‘একটু একটু বলতে পারি’। এখন পুজোতে ভোগ খেতে গিয়ে বলে, ‘আরও একটু দিন’ |
|
‘সত্য’ ছবিতে সহকারী পরিচালক ছিলেন বর্ণালি রায়। সেখানেই আলাপ অভিনেতা সৌরভ শুক্লর সঙ্গে।
সিনেমাটা শু্যটিং করার দ্বিতীয় শিডিউলে সৌরভ বর্ণালিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তাও সেটা পৃথ্বী থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে, একেবারে মাঝরাস্তায়! শুনে তো বর্ণালি গুচ্ছের গালিগালাজ করেন।
দিনটা ছিল ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭। বিয়ে হয় ১৯৯৮-এর পয়লা ফেব্রুয়ারি। পনেরো বছর একসঙ্গে থাকার পর সৌরভ এখন বাঙালি আদবকায়দা অনেকটাই রপ্ত করে ফেলেছেন। বর্ণালির কথা অনুযায়ী, সৌরভের জীবনে মিষ্টত্বের একটা নতুন মাত্রা এনেছে তাঁর বাঙালিয়ানা। “মিষ্টি কথাটার অর্থ এখন আর শুধু চিনিতে আটকে নেই। বাঙালিদের রসবোধটা ওর পছন্দ। বাংলা ভাষাটাও। আগে ওর বাংলা বলতে পারা মানে ছিল ‘একটু একটু বলতে পারি’। এখন পুজোতে ভোগ খেতে গিয়ে বলে ‘আরও একটু দিন’, বলেন ‘কুছ লভ য্যয়সা’-র পরিচালক বর্ণালি। মজা করতে করতে তিনি বলেন তাঁর স্বামীর বাঙালিয়ানা তাঁকে অনেকটাই লেস কনজিউমারিস্ট করে দিয়েছে। “তাই ওর কাছে এফএমজিসি শব্দটির মানে আজকে ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস নয়। তার অর্থ ফিশ ফ্রাই, মোচা, চিংড়ি ঘণ্ট,’’ বলেন বর্ণালি।
বাংলা ভাষার খুঁটিনাটি সম্পর্কেও সৌরভের বেশ আগ্রহ। ছোট ছোট পার্থক্যগুলো করতে পারে। যেমন কখন বলা উচিত ফাটাফাটি আর কখন ব্যাপক। কোনটা ন্যাকামি আর কোনটা ঢং। কখন বলা দরকার কেটে পড়া এবং আজ আসি! তবে আমরা কোনও দিন ঝগড়া করিনি বাংলায়,’’ বলেন বর্ণালি।
আপাতত বর্ণালি-সৌরভ বেঙ্গালুরুতে একটা রোড ট্রিপ-এ ব্যস্ত। বাড়ি ফিরে পয়লা বৈশাখ সেলিব্রেশন হবে। লুচি, কষা মাংস দিয়ে পার্টি। আর নিউ ইয়ার রেজলিউশনও আছে। সৌরভের জন্য বাংলা স্ল্যাং-এর রিফ্রেশার কোর্স শুরু করবেন তিনি!
|
কে কে মেনন (অভিনেতা)
পায়েস খেতে খুব ভালবাসেন
|
|
|
নিবেদিতা ভট্টাচার্য |
পয়লা বৈশাখ আর মালয়ালম নিউ ইয়ার এক দিনে পড়ে। তাই আজ আমাদের বাড়িতে প্রচুর খাওয়াদাওয়া |
|
নিবেদিতার সঙ্গে কে কে মেননের প্রথম দেখা হয় থিয়েটার করতে গিয়ে। নিবেদিতা প্রবাসী বাঙালি। বহু বছর লখনউতে থেকেছেন। ওখানে দুর্গাপুজোর সময় থিয়েটার করা শুরু। তার পর চলে আসেন মুম্বইতে। সেখানে কে কে-র সঙ্গে দেখা। প্রেম। বিয়ে। “কত বছর বিয়ে হয়েছে জিজ্ঞেস করলে বলব, হিসেব করা ছেড়ে দিয়েছি। আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার অনেক আগে থেকেই কে কে-র বাঙালি বন্ধু ছিল। ও তাই বাঙালি আদবকায়দাটা বেশ ভালই জানত। আমাকে সে ভাবে নতুন করে কিছু শিখিয়ে দিতে হয়নি,” নিবেদিতা বলেন।
নিবেদিতা এবং কে কে দু’জনেই গান পছন্দ করেন। ‘‘কে কে বেশ ভাল গান গায়। কিন্তু কোনও দিন ওর গলায় বাংলা গান শুনিনি। তবে ভাল গান শুনতে দু’জনেই খুব পছন্দ করি। বাংলা ভাষাটা ও বেশ বুঝতে পারে। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতেও পারে,” নিবেদিতা বলেন।
আর খাবার? ‘‘মিষ্টি খুব একটা পছন্দ করে না। তবে এক বাটি পায়েস দিয়ে দিলে ওর আর কিছু চাই না। পায়েস ওর দারুণ পছন্দ। প্রত্যেক বছর পয়লা বৈশাখ আর মালয়ালম নিউ ইয়ার ভিশু একই দিনে পড়ে। আমাদের সে দিন জম্পেশ খাওয়াদাওয়া হয়। পায়েস তো হওয়া চাই-ই চাই। আমার মা বা শাশুড়ি-মা পায়েস বানান। তা ছাড়াও থাকে কেরলের সমস্ত ভাল রান্নাবান্না। সে দিনটা ভালমন্দ খেতে খেতেই কেটে যায় আমাদের,” বলেন নিবেদিতা।
|
প্রহ্লাদ কক্কর (অ্যাডম্যান)
পয়লা বৈশাখে ইলিশ পাতুরি হতেই হবে
|
|
|
মিতালি দত্ত কক্কর |
প্রহ্লাদকে বিয়ে করব শুনে বাবা বলেছিলেন, বাঙালি মানে কালচার। পঞ্জাবি মানে এগ্রিকালচার। তুই কালচার ভুলে এগ্রিকালচারে গেলি? |
|
মিতালির বয়স তখন তেইশ। অ্যাডম্যান প্রহ্লাদ কক্করের ছত্রিশ। এক দিন প্রহ্লাদের অফিসে মিতালি যান এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে। প্রথম দেখাতেই আকৃষ্ট হয়েছিলেন প্রহ্লাদ। মিতালিকে একটি শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন করতে ডাকলেন। “প্রথম ওর অফিসে যে দিন গিয়েছিলাম, জানতামই না ও প্রহ্লাদ কক্কর। মুখে একগাল দাড়ি, পা ভাঙা। তাড়াতাড়ি শু্যটিং শেষ করে কলেজে ফিরে যাই। প্রেমে পড়ি পরে। কিন্তু প্রহ্লাদ বিয়ে করতে চায়নি। আমি চেয়েছিলাম ঘরসংসার করতে। এক সময় ওকে বলি হয় আমাকে বিয়ে করতে হবে, নইলে একেবারে ভুলে যেতে হবে,” বলেন মিতালি।
প্রহ্লাদ রাজি হয়ে যান। তার পর মিতালি ওঁকে নিয়ে যান শিলিগুড়িতে। “আমার বাবা টি প্ল্যান্টেশনে চাকরি করতেন। প্রথম যে দিন শোনেন আমি প্রহ্লাদকে বিয়ে করতে চলেছি, আমাকে বলেন, ‘বাঙালিরা মানে কালচার। আর পঞ্জাবিরা মানে এগ্রিকালচার। তুই শেষে কালচার ভুলে এগ্রিকালচারে গেলি?’” হাসতে হাসতে বলেন মিতালি।
১৯৮৩ সালে বিয়ে হয়। রিসেপশন হয়েছিল তিন জায়গায়। শিলিগুড়ি, কলকাতা আর মুম্বইয়ে।
তিরিশ বছর বিয়ের পর প্রহ্লাদ এখন অনেকটাই বাঙালি। সর্ষে ইলিশের ভক্ত। এমনকী মাছের কাঁটা আর আঙুল দিয়ে না বেছে জিভ দিয়েই বাছতে শিখে গিয়েছেন। “প্রহ্লাদ শুক্তো-চচ্চড়ি সব খায়। ইলিশ মাছটা খুব প্রিয়। পয়লা বৈশাখে ইলিশ পাতুরি খাওয়া চাই-ই চাই,” জানান মিতালি।
এ দিকে প্রহ্লাদ জানান যে তাঁর সব থেকে মজা লাগে বাঙালিদের উচ্চারণ শুনতে। “আমি নিজে পঞ্জাবি। বেশ হাসি পায় যখন দেখি বাঙালিরা অদ্ভুত ভাবে পঞ্জাবি আর পাঞ্জাবি (কুর্তা) শব্দ দু’টোর মধ্যে উচ্চারণের ফারাক করতে পারেন না। হয়তো দাঁড়িয়ে আছি একটা দোকানের সামনে। একটা মেয়ে দেখি বলছে, “দেখ, পঞ্জাবিটা কী সুন্দর!” আমি ভাবলাম, আমাকে বলছে। ওমা! পরে বুঝি, আমার পিছনে টাঙানো একটা কুর্তার প্রশংসা করছে!” |
|