নববর্ষ আসছে
মোনালিসাকে নিয়েই চিন্তা! আজ নববর্ষের সকালে গুরুজনেরা নির্ঘাত জ্ঞান দিয়ে তার কান ঝালাপালা করে দেবেন।
সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী মোনালিসাকে পয়লা বৈশাখের প্ল্যান জিজ্ঞেস করেছিলাম। ‘‘ইটিং আউট। ছুটির দিন, বন্ধুরা মিলে দুপুরে বাঙালি খাবার খেতে যাব, ঠিক করেছি। মোচা চিংড়ি, চিকেন কষা, দেন রসগোল্লার পায়েস। ডিড ইউ নো, আই লাভ মোচা চিংড়ি?’’ চমৎকার! কিন্তু নতুন বাংলা সনটা কত? ১৪১৯ না ’২০? “মাই গুডনেস!” লজ্জায় জিভ কাটল মেয়ে, “এম্মা, এটা জানা উচিত ছিল, না? সে দিন দেখে নেব, প্রমিস।”
তার পর থেকেই চিন্তায়। আজ খবরের কাগজে, টিভিতে নির্ঘাত গুরুজন ও বিদ্বজ্জনেরা মোনালিসাদের উদ্দেশে দুঃখের ঝাঁপি খুলে বসবেন। এখনকার ছেলেমেয়েরা পুরো বাংলায় একটা বাক্যও বলতে পারে না, মাঝে মাঝেই ইংরেজি গুঁজে দেয়। সারাক্ষণ ‘চ্যাটে’ মেতে থাকে, জিন্স আর টপ পরে, বাংলা সনটাও ঠিকঠাক জানে না। পয়লা বৈশাখ ছিল বটে পঞ্চাশ বছর আগে, তাঁদের আমলে। সবাই ধুতি পরত। হেমন্ত, সন্ধ্যা ছাড়া গান শুনত না। নববর্ষ এখন মৃত উৎসব, ছুটি ছাড়া অন্য তাৎপর্য নেই।
উৎসব দুর্গা পুজো থেকে ইতুপুজো সবই। অনেকের ধারণা, র্যাট রেসে পিছিয়ে বাংলা নববর্ষ। ‘নিউ ইয়ার্স ইভ’ থেকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’, ‘ফাদার্স ডে’, ‘মাদার্স ডে’ বরং অনেক এগিয়ে। ৩১ ডিসেম্বর রাতের আলোময় মেজাজের ধারেকাছেও আসে না পয়লা বৈশাখ। ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উপচে-পড়া ভিড়ের সঙ্গে তুলনাই হয় না তার।
সংশয়বাদীরা কালীঘাট থেকে ঘুরে আসতে পারেন। পুলিশ-সূত্রের খবর, সেখানে আজ অন্তত ৫০ হাজার লোকের ভিড় হবে। দক্ষিণেশ্বর, লেক কালীবাড়ি, তারাপীঠের কথা ছেড়েই দিন।
এখানেই আসল গল্প। ভ্যালেন্টাইন্স ডে, বড়দিনের ভিড়টা কার্ড-ইন্ডাস্ট্রি, শপিং মল, নিউ মার্কেট, কেক-প্যাস্ট্রির দোকানের দৌলতে সহজে চোখে পড়ে। কিন্তু পয়লা বৈশাখের মাপকাঠি অন্য। সেটি থাকে মন্দিরে, পঞ্জিকায়। “পঞ্জিকার বিক্রি ফি বছর বাড়ছে। অন্তত ২০ লাখ কপি বিক্রি,” বলছেন গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার অরিজিৎ রায়চৌধুরী। অন্য দিকে, আনন্দ পাবলিশার্সের সুবীর মিত্রের মতে, বাংলা উপন্যাস হাজার পাঁচেক বিক্রি হলেই বেস্টসেলার!
এই মাপকাঠিটা জানা নেই বলেই, শহুরে উচ্চবর্গের ধারণা, পয়লা বৈশাখের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছে। কারণ, বাঙালি ছেলেমেয়েরা বাংলা সনটাও ঠিকঠাক জানে না। “কেউ পয়লা বৈশাখ বললেই কুইজ কনটেস্টের মতো বাংলা সন জিজ্ঞেস করতে হবে কেন? পয়লা বৈশাখের সঙ্গে বাংলা শাস্ত্রীয় উৎসবের কোনও যোগ নেই,” হাসলেন ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অতি প্রাচীন কালে অগ্রহায়ণ ও পরে ফাল্গুন মাস থেকে বছর শুরু হত। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে খাজনার হিসেবের সুবিধার জন্যই বঙ্গাব্দ শুরু হয়। “কিছু উৎসবের তারিখ আমরা বাংলায় খেয়াল রাখি, কিছু ইংরেজিতে। ১৫ অগস্ট, ২৬ জানুয়ারি ইংরেজিতে। কিন্তু পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ বাংলায়। তখন ইংরেজিটা গুরুত্বহীন। পয়লা বৈশাখ ১৪ না ১৫ এপ্রিল, তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না,” বললেন তিনি। সন নয়, ঐতিহ্য নয়, তারিখটাই গুরুত্বপূর্ণ।
 
একটা কথা পরিষ্কার বলা দরকার। ‘পয়লা বৈশাখ’ উৎসব নিতান্ত অর্বাচীন, ইংরেজ আমলেই তার উৎপত্তি। বাঙালি গ্রামসমাজ ছিল মুখ্যত কৃষিজীবী। সেখানে চড়ক, পৌষ-পার্বণ, নবান্ন ইত্যাদি ছিল বড় উৎসব। ঔপনিবেশিক জমানায় দেখা গেল, ১ জানুয়ারি বছরের প্রথম দিনটি ছুটি। অগত্যা বাঙালি ভাবল, সাহেবদের থাকলে আমাদেরই বা নয় কেন? নগর কলকাতায় তৈরি হল নতুন এক ‘সেকুলার উৎসব’। পয়লা বৈশাখ প্রথম থেকেই খোঁড়া পায়ে দৌড়েছে, গ্রামবাংলার নবান্ন বা পৌষ-সংক্রান্তির জনপ্রিয়তা তার ছিল না। আবার ব্রিটিশ শাসকদের ‘বড়দিন’, ‘নিউ ইয়ার্স ইভ’-এর গ্ল্যামারও ছিল না। আজও বাংলার কোনও কোনও গ্রামে পয়লা বৈশাখকে ‘বাসি চড়ক’ বলে।
চড়ক চোখে পড়ে না, কিন্তু নাগরিক সমাজে পঞ্জিকার বিক্রি ক্রমে বাড়ছে। কবে অলাবু ভক্ষণ নিষিদ্ধ, আর যাত্রা নাস্তি শুধু সেটুকুই সেখানে থাকে না। কোন তিথিতে শেয়ার কেনাবেচা উচিতও থাকে। ইন্টারনেটে, এসএমএসে পাওয়া যায় ডেইলি অ্যালার্ট। “ইন্টারনেট আমাদের ‘গ্লোবাল অ্যাকসেস’ অনেক বাড়িয়েছে। প্রবাসী বাঙালি ঘরে বসে বিয়ের তিথি, লগ্ন জেনে যাচ্ছেন। যাঁরা বিয়ের বাড়িভাড়া বা তত্ত্ব সাজানোর ব্যবসা করেন, তাঁরাও তারিখগুলি আগাম জানতে পাঁজি কিনছেন,” বলছিলেন অরিজিৎবাবু। পাঁজি যে কত বদলেছে, তার প্রমাণ নতুন ১৪২০-র পঞ্জিকা। সেখানে আজ পয়লা বৈশাখ অনেক কিছুর শুভযোগ। গাত্রহরিদ্রা, অব্যূঢ়ান্ন, ধান্যচ্ছেদন। পাশে একই সঙ্গে ‘কম্পিউটার নির্মাণ ও চালন।’ এই শুভযোগ তিরিশ বছর আগেও ভাবা যেত না।
তিরিশ-বত্রিশ বছর আগে পয়লা বৈশাখ কেমন ছিল, জানতে চোখ বোলাচ্ছিলাম ১৯৭৫ সালের পয়লা বৈশাখের ‘আনন্দবাজার’ কাগজে। কোনও ক্রোড়পত্র নেই, শুধু ‘হিমাদ্রি পাখা’, ‘এমব্যাসী হোটেল’ (তখন এই বানান লেখা হত) ইত্যাদি গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী শুভেচ্ছা। আর ১৩৮২ সাল কেমন যাবে, তা নিয়ে একটি নিবন্ধ। বিজ্ঞাপনদাতা থেকে পাঠকপাঠিকা, মিডিয়া কেউই দিনটাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি। পয়লা বৈশাখের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি, মিডিয়ার প্রভাব ইত্যাদি নিজেই বুঝে নিন।
তা হলে পয়লা বৈশাখের পিছিয়ে পড়া শীর্ষক উদ্ভট ধারণা এল কোথা থেকে? শহুরে উচ্চবর্গ আসলে নানা জিনিস একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। পয়লা বৈশাখের সঙ্গে বাংলা সন, ধুতি-শাড়ি পরতে বা না-পরতে পারার সঙ্গে বাঙালিয়ানা, বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলা ইত্যাদি। এঁরা বোঝেন না, কোঁচা লুটিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরাটাই বাঙালি সংস্কৃতি নয়। আদিযুগের ধুতি ছিল রীতিমতো খাটো, হাঁটু পর্যন্ত পরাই ছিল বাঙালি নিয়ম। কাছাকোঁচা দিয়ে মাঞ্জা মারা উনিশ শতকের নব্য বাবু-সংস্কৃতি। শাড়ির ব্যাপারটাও তাই। আঁচল পাশে ফেলে শাড়ি পরার কেতা মহারাষ্ট্রের অবদান। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর সৌজন্যেই বাঙালি এই ভাবে শাড়ি পরা শেখে। আদিতে বাঙালি মেয়েরা ব্লাউজ-টাউজও পরত না। চোলি বা ‘স্তনপট্ট’ দিয়ে বুক ঢেকে রাখা উত্তর ভারতের অবদান।
আর রান্না? গলদা চিংড়ির মালাইকারিও আদতে বাঙালি রান্না নয়। ওটি মালয় দ্বীপের দক্ষিণ ভারতীয়দের তৈরি রেসিপি। ‘কইমাছের হরগৌরী’, ‘মোচা চিংড়ি দিলখুস’ নামের আধুনিক বাঙালি খাবার দেখলে মঙ্গলকাব্যের কবিরা আজ ভিরমি খেতেন। তাঁদের রেসিপি অন্য রকম, ‘কটু তৈলে কই মৎস্য ভাজে পণ দশ/মুঠি নিঙ্গাড়িয়া তাহে দিল আদার রস।’
অতএব, খাঁটি বাঙালিয়ানা এবং সোনার পাথরবাটি দুটিই সমান অর্থহীন। বাঙালি সংস্কৃতি সবসময় চলমান। গ্রহণ-বর্জনে ক্ষান্তি নেই তার। পয়লা বৈশাখের ‘পয়লা’ শব্দটিই তো হিন্দি পহেলা থেকে নেওয়া।
এই গ্রহণ-বর্জনের নমনীয়তার কারণেই পিছিয়ে নেই পয়লা বৈশাখ। ইন্টারনেট থেকে পঞ্জিকা, মাছ-ভাত, পিৎজা, ধুতি, শাড়ি, জিন্স, লেহঙ্গা সবাইকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। সেখানেই বাঙালির নতুন বর্ষবরণ।

পয়লা পাঁচালি

দুর্গাপুজোয় ‘থিম’ যেমন, তেমনই
নতুন কিছু ‘ইনপুট’ দিলে তবেই
নববর্ষ হারানো জৌলুস ফিরে পাবে

নববর্ষের দিনটা ভুলেও যদি যাই
‘মিডিয়া হাইপ’ মনে করিয়ে দেবেই।
ফেসবুক, টুইটার, বিবিএম তো আছেই

বাংলা নববর্ষ আমি পালন করি। কিন্তু
সেটা ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র মতো হইহই
করে পালিত হবে কি না বলা সম্ভব নয়

বাংলা সালটা না-ই মনে থাকতে পারে।
কিন্তু নববর্ষের দিনটা বাঙালি ভুলে যাবে না।
পয়লা বৈশাখের আমেজটাই আলাদা

মডেল: শ্রাবন্তী; ছবি: দেবাশিস মিত্র;
হেয়ারস্টাইল: সোমা সাহা;
মেক আপ: নন্দা মজুমদার; স্টাইলিং: অয়ন হোড়;
রূপায়ণ ও বিন্যাস: অরিজিৎ চক্রবর্তী
পরিকল্পনা: প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.