সুশ্রী তরুণীর ছলছলে চোখ দেখে মধ্যচল্লিশের জাঁদরেল মহিলারও সন্দেহ হয়নি। বাড়িতে মায়ের অসুখ তা-ই কোনও মতে একটা চাকরি জুটিয়ে দেওয়ার জন্য রীতিমতো ঝুলোঝুলি করছেন মেয়েটি। তাঁর চোখের জলে ভুলেই বিহারের ‘ভাল চাকরি’তে তাঁকে পাঠাতে রাজি হয়ে যায় সলমা বিবি।
আর সেটাই তার কাল হল। শুক্রবার বিকেলে কলকাতা স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠার সময়ে বিহারে নারী পাচার চক্রের চাঁই সলমা বিবি পুলিশের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল। যাঁর নিখুঁত অভিনয়ে সে ফাঁদে পা দিল, তিনি আসলে সোনারপুর থানার এক তরুণী পুলিশ অফিসার। অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর সোনা মণ্ডল।
পুলিশ সূত্রের খবর, লক্ষ্মীকান্তপুরের কাছে ধপধপির বাসিন্দা সলমা বেশির ভাগ সময়েই থাকত বিহারে। মাঝেমধ্যে এই তল্লাটের গরিব ঘরের মেয়েদের ভাল চাকরির সুযোগ করে দিতে বিহারের সিওয়ানে ক্যাবারে নাচের দলে ঢোকাত সে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী শনিবার জানান, সলমা-সহ চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের মধ্যে রয়েছে রহমতুল্লা মোল্লা ওরফে লাল্টু, সাদ্দাম হুসেন পেয়াদা ও সিরাজুল পেয়াদা। পুলিশের দাবি, ‘পুরনো পাপী’ সলমা বিবিই দলের চাঁই। এই পোড়খাওয়া নারী পাচার-চক্রটিকে ধরতে পাড়াগাঁয়ের হতদরিদ্র ঘরের নারীরই ভেক ধরেছিল পুলিশ। বিপন্ন চাকরিপ্রত্যাশী মেয়ের ভূমিকায় অভিনয়ে বাজিমাত করেন এএসআই সোনা মণ্ডল। তাঁকে সামনে রেখেই ফাঁদ পাতা হয়েছিল ধুরন্ধর নারীপাচারকারীদের জন্য।
মাসখানেক আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামের এক তরুণীকে সিওয়ানের মাধোপুর থেকে উদ্ধার করে এনেছিল সোনারপুর থানার পুলিশ। রাজু নামে এক পাচারকারীকে গ্রেফতারও করেন তদন্তকারীরা। পুলিশ জানায়, চাকরির কথা বলে মেয়েটিকে ফুসলিয়ে সিওয়ানে নিয়ে যাওয়ার পরে সে ডান্স-পার্টির খপ্পরে পড়ে। নামমাত্র টাকার বিনিময়ে সকাল-সন্ধে বিহারের গাঁয়ে-গঞ্জে মদ্যপ জনতার সামনে স্বল্পবাসে নাচতে হত মেয়েটিকে।
তার সঙ্গে চলত যৌন নির্যাতনও।
এক পুলিশকর্তার কথায়, “গত কয়েক মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগনার গ্রামের নাবালিকাদের বার বারই বিহারে পাচারের অভিযোগ উঠেছে। প্রধানত, ‘ডান্স-পার্টি’তেই তাদেরই কাজে লাগানো হত।”
ওই তরুণীর কাছ থেকেই পাচারকারীদের বিষয়ে সূত্র জোগাড় করতে উঠে-পড়ে লাগে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানতে পারেন, এখনও এক কিশোরী সিওয়ানে রয়েছে। তার একটি ফোন নম্বরও পুলিশের হাতে আসে। সেই নম্বরে ফোন করেই লাল্টু বলে এক যুবকের ফোন নম্বর হাতে পান তদন্তকারীরা। এর পরেই এএসআই সোনাকে সামনে রেখে ছক কষে সোনারপুর থানার পুলিশ। সোনা লাল্টুকে ফোন করে বলেন, মায়ের অসুখের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে তাঁর এখনই চাকরি দরকার। লাল্টু জানতে চান, তিনি নাচতে জানেন কী না! সোনা ‘হ্যাঁ’ বলায় উৎসাহ দেখায় লাল্টু। দলের মাথা সলমার সঙ্গে দেখা করতে নির্দেশ দেয় সোনাকে।
পরিচিত একটি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সোনা ধপধপি স্টেশনে সলমার সঙ্গে দেখা করেন। সঙ্গী মেয়েটিও চাকরির আর্জি জানায়। ওই মহিলার সঙ্গে লাল্টু এবং আরও কয়েক জনও ছিল। কাছেই জেলার স্পেশ্যাল অপারেশন গ্রুপ ও স্থানীয় থানার তদন্তকারীরা ছদ্মবেশে উপস্থিত ছিলেন। তখনই সলমা ও তার সঙ্গীদের চিনে রাখে পুলিশ। সোনার কথা শুনে একটুও সন্দেহ হয়নি সলমার। সে তখনই সোনাকে বলে দেয়, পরের দিন (শুক্রবার) বিকেলে কলকাতা স্টেশনে গোরক্ষপুর এক্সপ্রেস ধরার জন্য অপেক্ষা করতে। ট্রেন আসার পরে সোনা ও তার সঙ্গী মেয়েটিকে নিয়ে ট্রেনে ওঠে পাচার চক্রের মাথা। সলমা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা কামরার ভিতরে বসতেই পুলিশ তাদের ঘিরে ফেলে। হাতে-নাতে ধরা পড়ে পাচারকারীরা। পুলিশ এখন ঝাঁপাবে সিওয়ানে বন্দি নাবালিকাটিকে উদ্ধারের জন্য। |