অগ্নিমূল্য এই বাজারে সারা দিন কাজ করলে সরকারি ভবঘুরে হোমের আবাসিকদের জন্য বরাদ্দ দৈনিক ৪ টাকা ৫ পয়সা! আর ভবঘুরে ছাড়া অন্য হোমের বাসিন্দাদের জন্য দৈনিক কর্মভাতার অঙ্কটা সাকুল্যে ৯ টাকা ১০ পয়সা! রাজ্যে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হোমগুলির অবস্থার উপর নজরদারি করতে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত বিশেষ পরিদর্শক দলের সদস্যেরা যা দেখে মন্তব্য করেছেন, “রাস্তার ভিখারিদের দৈনিক রোজগারও এর থেকে অনেক বেশি।”
হিসাব বলছে, সারা মাস হাতের কাজ, সেলাই বা আচার-পাঁপড় তৈরি করে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হোমের আবাসিকদের রোজগার মেরেকেটে ১৩০ টাকা! আর ভবঘুরে ছাড়া অন্যান্য হোমের আবাসিকেরা (যেমন পাচারের পর উদ্ধার হওয়া মেয়েদের হোম, বৃদ্ধবৃদ্ধাদের হোম, স্বধার হোম, শর্ট স্টে হোম, মানসিক অসুস্থদের হোম ইত্যাদি) তাঁদের শ্রমের মূল্য হিসাবে মাসে জোটাতে পারেন বড় জোর ২৮০ টাকা! পরিদর্শক দল এই হিসাবে স্তম্ভিত।
কলকাতা ও তার আশপাশে উত্তর-দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি জেলার মোট ২১টি হোম পরিদর্শন করে রিপোর্ট তৈরি করেছে ৭ সদস্যের পরিদর্শক দল। কিছুদিন আগে সমাজকল্যাণ দফতরে জমা দেওয়া সেই ১১ পাতার রিপোর্টে দলের সদস্যেরা প্রশ্ন তুলেছেন, ন্যুনতম মজুরির আইন যেখানে চালু সেখানে কোনও মানুষকে তাঁর পরিশ্রমের বিনিময়ে মাসে মাত্র ১৩০ টাকা বা ২৮০ টাকা কী করে দেওয়া যেতে পারে? এটা কি আদৌ মানবিক?
বিশেষ করে বিভিন্ন যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার করে আনা মেয়েদের নিয়ে পরিদর্শক দলের সদস্যেরা বিশেষ ভাবে চিন্তিত। তাঁদের যুক্তি, পর-পর একাধিক হোম থেকে যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার করা মেয়েদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তাঁদের মধ্যে যে ক’জনকে ফেরানো গিয়েছে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা। কথা বলেছেন একাধিক হোম কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও। পরিদর্শকদের মতে, হোমে রোজগারের কোনও স্থায়ী সংস্থান না-থাকাটা ওই মেয়েদের পালানোর চেষ্টার অন্যতম কারণ।
পরিদর্শক দলের প্রধান অশোকেন্দু সেনগুপ্ত জানিয়েছেন, যৌনপল্লিতে থাকলে এই মেয়েরা বাড়িতে দুই-আড়াই হাজার টাকা পাঠাতে পারেন। নিজেরাও কিছু পছন্দের বা শখের জিনিস কিনতে পারেন। তাঁর প্রশ্ন, হোমে সারা মাসে ২৮০ টাকা হাতে পেলে তাঁদের কোনও প্রয়োজন মিটবে কি? অশোকেন্দুবাবু জানিয়েছেন, কোনও স্থায়ী পুনর্বাসন বা বিকল্প রোজগারের ব্যবস্থাই সরকার করতে পারছে না। তাঁর মতে, এই অবস্থায় ওই মেয়েদের বাড়ি পাঠালেও তাঁদের অধিকাংশ আবার যৌনপল্লিতে চলে যাবেন।” দীর্ঘদিন সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত হোম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ইন্দ্রাণী সিংহ, বৈতালি গঙ্গোপাধ্যায়রাও এই রিপোর্টকে সমর্থন করেছেন। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, এই ১৩০ টাকা বা ২৮০ টাকাও সরকার অনেকসময় পাঠায় না।
ইন্দ্রাণীদেবীর কথায়, “২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত আমাদের হোমে কোনও টাকাই এল না। এই ভাবে মেয়েরা কেন থাকবে? তাদের ভবিষ্যৎ কী?” বৈতালিদেবী জানিয়েছেন, যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার হওয়া জনা ১৫ মেয়েকে দিয়ে তাঁরা লালবাজারে ক্যান্টিন চালাতেন। কোনও মেয়ে তখন পালায়নি। কাজ বন্ধ হতেই পালানোর চেষ্টা করেছে। তিনি জানিয়েছেন, ওই মেয়েদের একটু ভাল সাবান-শ্যাম্পু মাখতে ইচ্ছা করে, সাজতে ইচ্ছা করে। যৌনপল্লির জীবনে ওঁরা নিজেদের রোজগারের টাকা খরচে অভ্যস্ত হয়ে যান। বৈতালিদেবীর মতে, সেই রোজগারের বিকল্প সুযোগটুকু হোমে না পেলে এই গরিব মেয়েদের আটকানো যাবে না।
সমাজকল্যাণ সচিবের দফতর জানিয়েছে, রিপোর্ট পাওয়ার পর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ভবঘুরে হোমের আবাসিকদের দৈনিক ভাতা ৬০ টাকা এবং অন্যান্য হোমে দৈনিক ৭০ টাকা কর্মভাতা দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আগামী ২২ তারিখ আলোচনায় বসছেন দফতরের কর্তারা।
পরিদর্শক দল অবশ্য টাকার পাশাপাশি আবাসিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মনোরঞ্জনের উপরেও জোর দিয়েছেন। পরিদর্শন করা ২১টি হোমের কোনওটিতেই এই তিনটি বিষয়ের উপযুক্ত ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি। পরিদর্শকদের সুপারিশ, প্রত্যেক হোমে প্রত্যেক আবাসিকের থাকার জন্য ৪০ বর্গফিট ঢাকা এলাকা ও ৬০ বর্গফিট খোলা এলাকার ব্যবস্থা করতে হবে। যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার হওয়া মেয়েদের জন্য হাওড়া বা শিয়ালদহ এলাকায় ‘ট্রানজিট হোম’ তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। শিশু, বৃদ্ধাদের সঙ্গে ওই মেয়েদের না রেখে ওই ‘ট্রানজিট হোমে’ রেখে মানসিক কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা হবে।
প্রতিটি হোমে ১০ জন আবাসিক পিছু একটা কম্পিউটার, ২০ জন পিছু টেলিভিশনের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। রাখতে বলা হয়েছে গান ও নাচের শিক্ষক-শিক্ষিকা, খেলার সরঞ্জাম, খেলার মাঠ, অন্তত একটা জেনারেটর, গ্রন্থাগার, স্থায়ী চিকিৎসক, নার্স, কাউন্সেলার, আধুনিক শৌচাগার ও পানীয় জলের ব্যবস্থা। |