দশ কোটি টাকা ব্যাঙ্ক জালিয়াতি করে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন বছর পাঁচেক আগে। তিনিই আবার পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের ১২০ কোটি টাকা তছরুপের প্রধান আসামি। তদন্তে এমনটাই জেনেছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দাদের দাবি অনুযায়ী, জালিয়াতির নায়ক সেই ইন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়। তফাৎ শুধু সময়ের। তফাৎ শুধু জালিয়াতির অঙ্কের। শুধু পাঁচ বছর আগের তুলনায় এ বারের জালিয়াতির অঙ্ক ১২ গুণ বেশি।
ব্যাঙ্ক ও নিগমের কর্তাদের কয়েক জনের সঙ্গে যোগসাজসেই ইন্দ্রজিৎ এত বড় জালিয়াতি করেছে বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত।
পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের ১২০ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ জমা পড়ে ১৩ মার্চ । নিগমের চেয়ারম্যান অভিরূপ সরকারের অভিযোগের ভিত্তিতে হেয়ার স্ট্রিট থানায় একটি এফআইআর দায়ের হয়। তদন্তভার দেওয়া হয় লালবাজারের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখাকে। কতকটা কাকতালীয় ভাবে ওই ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার গোয়েন্দাদের হাতেই ২০০৮-এর ২৩ জুন গ্রেফতার হয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎ। সে বার শিয়ালের কুমিরছানা দেখানোর মতো পার্ক সার্কাসের একটি মাত্র ফ্ল্যাটের দলিলই ছ’টি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখে ঋণের নামে ইন্দ্রজিৎ প্রায় দশ কোটি টাকা তুলে নিয়েছিলেন। আসল দলিলের হুবহু নকল দলিলই তখন ছিল ইন্দ্রজিতের জালিয়াতির অস্ত্র।
আর এ বার কী কৌশলে১২০ কোটি টাকা হাতালেন ইন্দ্রজিৎ? |
পশ্চিমবঙ্গ পরিকাঠামো উন্নয়ন ও বিত্ত নিগমের টাকা যেখানে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে বেশি সুদ পেতে অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে জমা পড়ার পরে ফিক্সড ডিপোজিট (এফডি) হওয়ার কথা, ইন্দ্রজিৎ সেই টাকা মাঝপথেই তুলে নিয়েছে বলে গোয়েন্দাদের দাবি। নিয়ম মতো দ্বিতীয় ব্যাঙ্কটির সাসপেন্স অ্যাকাউন্টে প্রথমে ওই টাকা জমা পড়বে। তার পরে তা জমা হবে নিগমের এফডি অ্যাকাউন্টে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের সাসপেন্স অ্যাকাউন্টে জমা পড়ার পরে তা চলে গিয়েছে ইন্দ্রজিতের খোলা অ্যাকাউন্টে। সেখান থেকে আবার ওই কোটি কোটি টাকা ঘুরেছে বিভিন্ন ব্যাঙ্কে ইন্দ্রজিতের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে। গোয়েন্দারা পশ্চিমবঙ্গের ২৫টি ব্যাঙ্কে অন্তত ২০০টি এই ধরনের অ্যাকাউন্টের সন্ধান এখনও পর্যন্ত পেয়েছেন।
তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা দেখেন, ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কলেজ স্ট্রিট শাখায় জমা থাকা ১২০ কোটি টাকা নিগম সার্কাস অ্যাভিনিউয়ের ইউকো ব্যাঙ্কে দু’দফায় (৫৯ কোটি ও ৬১ কোটি) এফডি করে। গত বছরের শেষে ও এই বছরের গোড়ায় সেই টাকা জমা পড়ে। ব্যাঙ্ক সেই মর্মে নিগমকে সার্টিফিকেটও দেয়। কিন্তু পরে দেখা যায়, সার্টিফিকেটগুলি জাল। নিগমের টাকা বেবাক অন্য একটি সংস্থার অ্যাকাউন্টে চলে গিয়েছে।
এক তদন্তকারী অফিসারের কথায়, “নিগমের কয়েক জন এবং ইউকো ব্যাঙ্কের কয়েক জন ইন্দ্রজিৎকে এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছে। তবে মাথা হিসেবে জালিয়াতির টাকার সিংহ ভাগ পেয়েছে ইন্দ্রজিৎই। ইন্দ্রজিৎকে গ্রেফতারের পরেই জানা যাবে সেই সরকারি টাকা এখন কোথায়।”
২০০৮ সালে
ইন্দ্রজিতের ছবি। |
তদন্তে নেমেই ইউকো ব্যাঙ্কের সার্কাস অ্যাভিনিউ শাখার ম্যানেজার অ্যালয়েস লাকড়াকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে সোয়া কোটি টাকারও বেশি উদ্ধার করা হয়েছে। ধরা হয়েছে ইন্দ্রজিতের অন্য পাঁচ সাগরেদকেও, যারা ব্যাঙ্কের লোক সেজে নিগমে মাসের পর মাস গিয়েছেন। গোয়েন্দাদের দাবি, ইন্দ্রজিৎকে ধরতে তাঁরা জাল প্রায় গুটিয়ে এনেছেন। নিগমের কারা এবং ব্যাঙ্কের আর কোন কোন অফিসার এই তছরুপে জড়িত, সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নিগমের কেলেঙ্কারিতেও ইন্দ্রজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের নাম জেনে গোয়েন্দারা তাজ্জব বনে যান। তাঁরা জানতে পারেন, গত বছরের শেষ দিকেই ইন্দ্রজিৎ তাঁর স্ত্রী রসিকা চট্টোপাধ্যায়ের নামে কেনা সাউথ সিটি-র একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকতেন। গোয়েন্দাদের দাবি, নিগম জালিয়াতির টাকাতেই সেটা কেনা। এ ছাড়া আরও অনেক সম্পত্তি এই টাকায় করা হয়েছে। ২০০৮ সালে ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনায় রসিকাও
গ্রেফতার হয়েছিলেন। মাস ছয়েক পরে দু’জনেই জামিনে মুক্ত হয়ে বেরোন। তার আগেই অবশ্য ওই জালিয়াত দম্পতির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় পুলিশ। ইন্দ্রজিৎ ও রসিকার বিরুদ্ধে ব্যাঙ্কশাল ও আলিপুর কোর্টে মামলা চলছে। কিন্তু ইন্দ্রজিৎ আদালতে হাজিরা না-দিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন বলে গোয়েন্দারা জানতে পারেন।
সে বার ধরা পড়ার পর ইন্দ্রজিৎ দাবি করেন, ১৯৮২ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি সপ্তম হয়েছিলেন। তবে কোনও প্রমাণ পেশ করতে পারেননি নিজের দাবির সপক্ষে। এক গোয়েন্দা অফিসারের কথায়, “ইন্দ্রজিৎ মাধ্যমিকে সপ্তম হয়েছিল কি না, তা প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু জালিয়াতিতে সে যে ফার্স্ট হতে পারে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।” |