এখনই বলছে চল্লিশ। না বললেও টের পাওয়া যাচ্ছে তাপটা। ঝড়ের আশ্বাস নেই। ভয় করছে থমথমে গরমটায়। দুুপুরে খেয়াল ছিল না, অফিসের মধ্যে টের পাওয়া যায় না। বেসমেন্ট-এর কার পার্কেও নয়। হুস করে বাইরে বেরোতেই টের পেলাম পরিস্থিতিটা। চাকরি শুরু করার প্রথম চার-পাঁচ বছর এতটা ভয় পেতাম না। এখন পাই। কাচ উঠল প্রায় নিঃশব্দে। হিসহিসে শব্দে এসি চালু হল। গাড়িটা এখন অ্যাকোয়ারিয়াম। সদ্য নামা প্রথম শীতের আমেজ। তৃপ্ত হতে গিয়ার শিফ্ট করলাম। দৃপ্ত পায়ে আদুরে চাপ দিলাম অ্যাক্সেলারেটরে। রিয়ার ভিউ মিররে পিছিয়ে যাওয়া রাস্তায় আরও অনেক গাড়ি, প্রায় সবাই সাইডলাইট জ্বেলেছে, আলো কমে এসেছে, আমিও জ্বাললাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল ককপিটে বসে আছি। ড্যাশবোর্ডে ফুয়েল গেজ’টা দেখে নিলাম। গতকালই তেল নিয়েছি। আজ একটু যেন কম দেখাচ্ছে, যাক গে, এসি বন্ধ করার প্রশ্নই উঠছে না। ডান দিকের সাইডভিউ মিররের ওপরে ছাপা কথাটা রোজই দেখি, ‘যা দেখছ, তা যতটা দূরে ভাবছ ততটা নয়।’ হাসলাম মনে মনে, অনেক রাস্তা পেরোনো বাকি এখনও।
ট্র্যাফিক লাইট দেখতে পাচ্ছিলাম দূর থেকেই। বদলে যাওয়া সংখ্যাটাও, সবুজ থেকে হলুদ হওয়ার আগেই ছিটকে বেরিয়ে যেতে পারতাম ক্রসিংটা। কেউ একটা বিশ্বাসঘাতকতা করল। এক বার হলুদ আলো ফ্ল্যাশ করেই নিথর লাল হয়ে গেল। আমার আগের হুন্ডাই-টা পেরিয়ে গেল। এক রাশ বিরক্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ব্রেকটায়, ইঞ্জিন সুইচ অফ করে দিলাম। দিয়েই আবার চালালাম, এসিটা চলুক এখন। পুড়ুক তেল, চার পাশে পৃথিবী পুড়ছে, আমি পুড়ব কেন?
আমার ডান পাশে একটা বাস, জানলার মধ্যে মুখগুলো দেখলাম, সব পাথরের মতো। বাঁ পাশে একটা ফোক্সভাগেন, কাচটা আধ ইঞ্চি ফাঁক, ভেতরের লোকদের দেখা যাচ্ছে না। আর কিছু দেখার নেই। করারও নেই। টিপে দিলাম সিডি প্লেয়ারের বোতামটা। খেয়াল নেই, কী লাগানো আছে ওতে। এক মুহূর্ত পরেই বিখ্যাত গিটার ইন্ট্রো, হেমন্তের ভেলভেট গলা ‘এক গোছা রজনীগন্ধা, হাতে দিয়ে বললাম, চললাম’ মনটা ভাল হয়ে গেল। |
চোখ পড়ল পাশের গাড়ির সামনের জানলার কাচে, সেটা কয়েক ইঞ্চি নামল। তার পর তাড়াহুড়ো করে আবার একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। ওই সময়ের মধ্যেই চোখে পড়ল একটা মাথার প্রবল নড়াচড়া, যেন ভীষণ ব্যস্ত, এগোচ্ছে, পিছোচ্ছে, কিছু একটা মরিয়া হয়ে বলতে চাইছে। এখন অবশ্য সেটা আর স্পষ্ট নয়। পিছনের সিটে কে আছে বা আদৌ কেউ আছে কি না দেখতে পাচ্ছিলাম না। এক বার স্পিডোমিটারে চোখ পড়ল, কাঁটাটা নিশ্চিন্তে মাথা রেখেছে শূন্যের কাঁধে। চার পাশ দেখলাম। সবাই কেমন যেন নিথর, কত ক্ষণে সিগন্যাল বদলাবে কে জানে। স্টিরিয়োতে ভেসে আসছে ‘বেশ কিছু সময় তো থাকলাম, ডাকলাম, মন রাখলাম’, তার পরেই উচ্ছ্বসিত ইলেকট্রিক গিটারটা।
পাশের গাড়ির পিছনের দরজাটা এক বার খুলল। তার পর ভেতর থেকেই টেনে বন্ধ করে দিল কেউ ধড়াম করে। সামনের জানলার পিছনের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, পুরুষ মূর্তি, নিঃসন্দেহে। সামনের সিট থেকে পিছনে ঘুরে কিছু একটা করার চেষ্টা করছে সে। একটা কৌতূহল হচ্ছিল, দেখি কী হচ্ছে ওখানে। দেখবার চেষ্টা করতেই আটকা পড়ে গেলাম, কারণ সিট বেল্ট বাঁধা রয়েছে আমার। ফটাস করে খুলে ফেললাম সেটা, তার পর বাঁ দিকের জানলার দিকে এগোনোর মতলব করতেই বুঝলাম কাজটা সহজ নয়। মাঝখানে গিয়ার রয়েছে। কাচটা প্রথমে নামালাম, যাতে দেখতে সুবিধে হয়। তার পর যতটা সম্ভব নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। আমার মন বলছে আসল ঘটনা ঘটছে পিছনের সিটে। এক বার কনুইটার চাপ খেয়ে আমার গাড়ির হর্নটা জোর বেজে উঠল। পরিষ্কার দেখলাম ট্র্যাফিক পুলিশ বিরক্ত মুখে আমার দিকে তাকাল। এক বার লালবাতি জ্বললে হর্ন বাজানোর কিছু নেই। আশা করা যায় সে এ দিকে এসে আমাকে কিছু বলবে না, কারণ মোড়ের মাথায় লরি এসেছে, লরি কিছু একটা বলতে চায় ওকে।
কাচ নামানোর সঙ্গে সঙ্গে হলকার মতো শব্দ ঝাঁপিয়ে পড়ল জানলা দিয়ে। বহু মানুষের গলা, ইঞ্জিনের অসহিষ্ণু গরগরানি আর ক্রমাগত হর্ন বোধ হয় আকাশেও বেজে চলেছে। চাপা পড়ে গেছে হেমন্তের গলা, আর্তনাদের মতো শোনাচ্ছে পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ানে ইন্টারল্যুড মিউজিক। এর পরে যে লাইনটা শুনতে পাব সেটা আমার জানা, ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে, এই জায়গাটা এলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়। এখন দিল না কারণ অন্য ঘটনা ঘটছে সামনে। এক রাশ গোলাপ ফুল নিয়ে এসেছে ভাঙাচোরা চেহারার এক জন মানুষ। নিয়ম মাফিক ময়লা জামা। খোলা জানলায় মুখ নামিয়ে বাইরে থেকে বোঝার চেষ্টা করছে গাড়িতে কোনও মহিলা আছে কি না। থাকলে গোলাপগুচ্ছ গছানোর উত্সাহ বেশি হবে। নেই। তা সত্ত্বেও সে জলের বিন্দু মোড়া সদ্য ফুটতে বসা ফুল এগিয়ে দিয়েছে আমার দিকে। জানলার কাছে এতটা এগিয়ে আসার জন্যই ওর ধারণা হয়েছে যে আমি আগ্রহী। ‘দেখলাম দু’টি চোখে বৃষ্টি’ এই মহাসুন্দর শব্দের মধ্যে ওকে বলতে চাইলাম, ‘না না লাগবে না,’ কিন্তু বলতে পারলাম না, হাওয়ার মধ্যে হাত নেড়ে ‘হঠ্ যাও’ বলা গেল না। সে সিটের ওপর ফুলের তোড়া নামিয়ে দিয়ে বলল, ‘ফিফটি’। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে বিদায় করে আবার নিজেকে চেপে ধরলাম জানলায়।
পাশের জানলার কাচ নামতে শুরু করেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে অত্যন্ত উত্তেজিত মাঝবয়েসি এক জন মানুষকে। সামনে আর কেউই নেই। উনি দু’টো সিটের মাঝখান দিয়ে নিজেকে গলিয়ে দিয়েছেন। দু’হাত দিয়ে ধরবার চেষ্টা করছেন কিছু একটা। বা কাউকে। মানুষটা এক বার আমাকে দেখলেন। তার পর আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, বিশেষ পাত্তা না দিয়েই, আমি আবার আমার সিটে বসে পড়লাম, যেমন ভাবে আমার বসে থাকা উচিত, সেই ভাবে। চার পাশের আওয়াজ আর কানে আসছে না। নিউট্রালে থাকা গাড়ির ইঞ্জিন যে চালু রয়েছে সেটার মৃদু কাঁপুনিটা টের পাচ্ছি। ড্যাশবোর্ডে জোনাকির মতো আলো জ্বলে আছে, জ্বেলে রেখেছি বলে। সামনের রাস্তা পেরিয়ে চলেছে অফুরন্ত গাড়ি, পর পর, শেষ হচ্ছে না। স্থির হয়েই আছে লাল আলোটা, সন্ধে হয়ে আসা আকাশে শুক্রগ্রহের মতো। স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে আমিও বসে আছি স্থির হয়ে। পাশের গাড়ির কাচ তোলা। বন্ধ দরজার ভিতর কী হচ্ছে সে ব্যাপারে মাথা না দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে।
কয়েক বছর আগেকার একটা কথা মনে পড়ে গেল। গাড়িতে আর এক জন ছিল সে দিন। এখন যেখানে গোলাপের তোড়াটা পড়ে রয়েছে, বসেছিল ঠিক সেখানেই। আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, যেতে দিচ্ছিলাম পাশের গাড়িগুলোকে। কারণ, কথা বলতে চাইছিলাম আমি। যাকে বলা, সে কোনও কথার উত্তর দিচ্ছিল না, সটান সামনের দিকেই তাকিয়ে বসেছিল। আমি যা যা বলছিলাম, তার কোনও ভিত্তি ছিল না, তবুও বলার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম ক্রমাগত। এবং বুঝতে পারছিলাম, প্রত্যেকটা কথার পর চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে পাশের মানুষটার, আরও গভীর হচ্ছে ভুরুর মাঝখানের ভাঁজটা। দৃষ্টি চলে যাচ্ছে আরও অনেকটা দূরে। অসহায় ভাবে অপেক্ষা করছিলাম একটা কালবৈশাখীর।
চাইছিলাম বদ্ধ পরিবেশটা থেকে বেরিয়ে আসতে। কিছুই হল না। বৃষ্টিও নয়। বজ্রপাতও নয়। এমনই একটা ট্র্যাফিক লাইটে থামতেই সে শান্ত ভাবে দরজা খুলে নেমে গেল রাস্তায়। এক বারও পিছন ফিরে না তাকিয়ে মিশে গেল অজস্র থমকে থাকা, গরগর করতে থাকা গাড়ির সমুদ্রে।
আবার চোখ গেল বাঁ দিকে, কঠিন মুখে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছেন ভদ্রলোক। দৃষ্টি সোজা সামনে। আমি নিশ্চিত জানি, ওঁর মন পড়ে আছে পিছনের সিটে। এক বার আমাকে দেখলেন, দেখেই আবার পিছনে। হাত বাড়িয়ে ইন্ডিকেটর চালু করলেন। ডান দিকের কমলা ব্লিঙ্কারটা জ্বলতে নিভতে শুরু করল। তার মানে সিগন্যাল হলেই উনি ডান দিকে ঘুরবেন। অথচ দাঁড়িয়েছেন বাঁ দিকের লেন-এ। হয়তো উত্তেজিত আছেন, মাথা কাজ করছে না। এ দিকে হেমন্তের আকুতি আমার গাড়ির মধ্যে ‘এখানেই সব কিছু শেষ নয়’ সামনের গাড়ির স্রোত যেন একটু হালকা হয়েছে। ট্র্যাফিক পুলিশ হাঁটছে রাস্তার অন্য কোণ লক্ষ করে। সিগন্যাল-এর রং বদলাবে এ বার। ক্লাচে পা দিলাম। আড়চোখে বাঁ দিকে আর এক বার দেখলাম। একটা কথা কানে এল, জোরালো, গম্ভীর, রাগত স্বর। ‘স্টপ ইট। আই টোল্ড ইউ, স্টপ ইট।’ আমার উত্তেজনার পারদটা চড়েই আছে, ধমকে আছে, লাল আলোর মতো। বুঝতে পারছি মাথার একটা শিরা দপদপ করছে পাশের গাড়ির ইন্ডিকেটর ল্যাম্পের মতো। উনি এ বারে ইঞ্চি ইঞ্চি করে এগোচ্ছেন, সিগনালে সবুজ অ্যারো ডান দিকে দেখলেই আমাকে পিছনে ফেলে সটান ঘুরে যাবেন নিয়মের তোয়াক্কা না-করে।
হলও তাই। হলুদ আলো ফ্ল্যাশ করেই ঝলমল করে উঠল সবুজ আলোর তির দু’টো, ঝড়ের মতো বাঁক নিল গাড়িটা আমার ও পাশের বাসটার সামনে দিয়ে। এক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম দুষ্টুমিভরা এক জোড়া জ্বলজ্বলে চোখে, কান খাড়া করা একটা গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুরকে।
হেমন্ত তখনও গাইছেন, ‘লিখে নিও গল্পের শেষটা, থাক না, তবু রেশটা’। |