যখন ঘুম ভাঙল, তখন সারা গা ঘামে ভিজে জবজবে। মেঝেটা জলে ভেজা আর লাল টাইল্স থেকে গরম ভাপ বেরোচ্ছে। একটা ধূসর ডানার প্রজাপতি হলুদ আলোটার চার পাশে ঘুরে চলেছে, তার চোখে ঝিলমিল লেগে গেছে। আমি ঝোলা-বিছানা থেকে নেমে খালি পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। সাবধানে, কারণ লুকোনো গর্ত থেকে ঠান্ডা হাওয়ার আকর্ষণে বিছে বেরিয়ে এলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। খানিক ক্ষণ ছোট্ট জানলাটার কাছে দাঁড়িয়ে খোলা বাতাসে নিশ্বাস নিলাম। শোনা যাচ্ছিল রাত্রির নিশ্বাস, প্রকাণ্ড রাত্রি, নারীর মতো। তার পর ঘরের মাঝখানে ফিরে গেলাম, পাত্র থেকে জল নিয়ে পিউটার-এর বেসিনে ঢেলে টাওয়েলটা ভিজিয়ে বুক, পা মুছলাম। তার পর পোশাক পরলাম, পরার আগে ভাল করে দেখে নিলাম তার ভিতরে কোনও পোকামাকড় আছে কি না। সবুজ রং করা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলাম। দরজাতেই হোটেলের মালিকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এক চোখ কানা, স্বল্পভাষী লোকটি চেয়ারে বসে সিগারেট খাচ্ছিল, প্রায় চোখ বুজেই।
‘কোথায় যাচ্ছেন মশাই?’ ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞাসা করল সে।
‘একটু হেঁটে আসি। ঘরে গরমে থাকা যাচ্ছে না।’
‘সব তো এখন বন্ধ, আর এখানে রাস্তায় আলোও নেই। আপনি বরং হোটেলেই থাকুন।’
আমি কাঁধটা নাচিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, ‘এক্ষুনি ফিরে আসব।’ তার পর অন্ধকারে প্রবেশ করলাম। প্রথমে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, পাথর-বিছানো রাস্তায় আন্দাজে পা ফেলছিলাম। হঠাত্ই কালো মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ উঁকি মারল, একটা সাদা দেওয়ালের ওপর তার আলো এসে পড়ল দেওয়ালটা এখানে ওখানে ভাঙাচোরা। সাদা আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল, দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঝিরঝিরে হাওয়ায় তেঁতুল গাছের গন্ধ ভেসে আসছিল। |
পাতার আর পোকাদের আওয়াজে রাতটা গুনগুন করছিল। লম্বা ঘাসের মধ্যে ঝিঁঝিপোকার দল ঘাঁটি গেড়েছিল। আমি আকাশের দিকে মাথা তুললাম, সেখানেও তারাদের শিবির। আমার মনে হল, গোটা ব্রহ্মাণ্ডটা যেন বহু সঙ্কেতের এক বিপুল কাঠামো, অতিকায় সব অস্তিত্বের মধ্যে কথোপকথন। আমার কাজকর্ম, ঝিঁঝির আওয়াজ, তারাদের মিটমিট আলো সব কিছুই সেই কথোপকথনের অংশ, তার ধ্বনি, তার বিরতি। কী হতে পারে সেই শব্দ, আমি যার একটি ধ্বনিমাত্র? কে সেই শব্দ বলবে এবং কাকে? সিগারেটটা রাস্তার পাশে ছুড়ে দিলাম। পড়তে পড়তে সেটা এক আলোকিত রেখা এঁকে দিল, ক্ষণস্থায়ী কিছু স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল, যেন এক ছোট্ট ধূমকেতু।
অনেক ক্ষণ ধীর গতিতে হেঁটে চললাম। যে সব ওষ্ঠাধর এমন আনন্দিত শব্দাবলি উচ্চারণ করে চলেছিল, তাদের আশ্রয়ে আমার নিজেকে মুক্ত, নিশ্চিন্তমনে হচ্ছিল। রাত্রি যেন অনেক চোখের এক বাগান। রাস্তা পার হতে গিয়ে মনে হল, কেউ যেন একটা দরজা খুলে বেরিয়ে আসছে। ঘুরে তাকালাম, কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। জোরে হাঁটতে লাগলাম। কয়েক মুহূর্ত পরে কানে এল গরম পাথরের ওপর চপ্পলের আওয়াজ। এ বার আর পিছন ফিরতে চাইলাম না, যদিও বুঝতে পারছিলাম ছায়াটা আমায় ধরে ফেলছে। দৌড়বার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। হঠাত্ দাঁড়িয়ে গেলাম। আর নিজেকে রক্ষা করার আগেই অনুভব করলাম একটা ছুরির ডগা আমার পিঠে ছোঁয়ানো, আর একটা মিষ্টি স্বর আমাকে বলল, ‘নড়বেন না, নড়লেই ঢুকিয়ে দেব।’
মাথা না ঘুরিয়েই বললাম, ‘কী চান?’
‘আপনার চোখ।’ গলার স্বর নরম, প্রায় বেদনার্ত।
‘আমার চোখ? আমার চোখ নিয়ে কী করবেন? দেখুন, আমার কাছে সামান্য কিছু টাকা আছে, একদমই অল্প। সব আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি। আমায় যেতে দিন। মারবেন না।’
‘ভয় পাবেন না, আমি আপনাকে মারতে চাই না, শুধু আপনার চোখ দুটো চাই।’
‘কিন্তু কী জন্য আমার চোখ দুটো চান?’
‘আমার প্রেয়সীর একটা শখ আছে। ও এক তোড়া নীল চোখ চায়, আর এখানে ও রকম নীল চোখ বেশি লোকের নেই।’
‘আমার চোখ দিয়ে আপনার কাজ হবে না। ওগুলো নীল নয়, বাদামি।’
‘আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না। আমি ভালই জানি যে ওগুলো নীল।’
‘কিন্তু আপনি এ ভাবে এক জন ক্রিশ্চানের দুটো চোখ উপড়ে নিতে পারেন না। আপনাকে অন্য কিছু দিতে পারি।’
‘আমাকে বিবেকের বাণী শোনাবেন না।’ ওর গলার স্বর রুক্ষ। ‘সামনে ঘুরুন।’
ঘুরে দাঁড়ালাম। বেঁটে, ক্ষয়াটে চেহারা, মুখের অর্ধেকটা টুপির আড়ালে ঢাকা, ডান হাতে একটা লম্বা ছোরা, চাঁদের আলোয় চকচক করছে।
‘মুখটায় আলো ধরুন।’
একটা দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে নিজের মুখের সামনে ধরলাম। আলোয় আমার চোখ বুজে এল। ও শক্ত হাতে আঙুল দিয়ে টেনে আমার চোখটা খুলল। ভাল ভাবে দেখতে পেল না। আবার পা উঁচু করে খুব নজর করে দেখতে লাগল, দেশলাইয়ের ছ্যাঁকায় আমার আঙুল ঝলসে গেল। ছুড়ে ফেলে দিলাম। ও এক মুহূর্তের জন্য চুপ থাকল।
‘এ বার দেখলেন? ওগুলো নীল নয়।’
‘আপনি খুব চালাক। দেখা যাক, আর এক বার দেশলাইটা ধরান।’
আর একটা কাঠি জ্বালালাম এবং চোখের কাছে ধরলাম। আমার আস্তিন চেপে ধরে ও হুকুম দিল, ‘নিল ডাউন।’
আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম, ও এক হাতে আমার চুলের মুঠি ধরে আমার মাথাটাকে টেনে তুলে ধরল, তীব্র কৌতূহল আর উদ্বেগ নিয়ে ঝুঁকে পড়ল মুখের ওপর। ওর ছোরাটা নেমে আসতে আসতে আমার চোখের পাতা ছুঁয়ে ফেলল। আমি চোখ বন্ধ করলাম।
‘ভাল করে চোখ খুলুন’, ও বলল।
খুললাম। আগুনে চোখের পাতা পুড়ে গেল। হঠাত্ ও আমাকে ছেড়ে দিল।
‘নাঃ, এগুলো নীল নয়। কেটে পড়ুন।’
ও ভ্যানিশ করে গেল। আমি দু’হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে পাশের দেওয়ালটায় হেলান দিলাম। সামলে নিলাম। টলতে টলতে বহু চেষ্টায় উঠে দাঁড়ালাম। নির্জন শহরের রাস্তা ধরে ঘণ্টাখানেক ছুটলাম। যখন হোটেলে পৌঁছলাম, দেখলাম হোটেলের মালিক দরজার সামনেই বসে আছেন। কোনও কথা না বলে ঢুকে গেলাম। পর দিনই শহর ছাড়লাম। |