পার্থ চট্টোপাধ্যায় কেবল শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত-গবেষক নন, তাঁর জ্ঞানের ক্ষেত্র সমাজবিজ্ঞান। ছাত্রদের রাজনীতিচর্চা নিয়ে তাঁর মতামতের বিশেষ গুরুত্ব আছে। এ নিয়ে আনন্দবাজারে তাঁর প্রবন্ধের (‘ছাত্র রাজনীতি কি অবাঞ্ছনীয়?’, ৯-৪) নৈতিক ও সাংবিধানিক যুক্তি অখণ্ডনীয়। পার্থদার কাছ থেকে (প্রকাশ্য রচনায় এ ভাবে তাঁর উল্লেখ তিনি ক্ষমা করবেন) এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আমাদের দেশে ছাত্র-রাজনীতির অভ্যস্ত রূপ দেখে অনেকেই আতঙ্কে আশ্রয় খুঁজছেন আরও প্রাচীন ও অভ্যস্ত সেই নীতিতে, যে ছাত্রেরা কেবল মুখ গুঁজে লেখাপড়া করবে। এই প্রবন্ধকারের অভিমতও এমন সরল ও বিকৃত রূপে পরিবেশিত হয়েছে, সেটা আমার পীড়ার কারণ। ছাত্র-রাজনীতির সুস্থ ও কাম্য বিকাশের পক্ষে পার্থদার প্রবন্ধ এক জোরালো সওয়াল, তাকে স্বাগত জানাতেই হয়।
ছাত্ররা সমাজ ও পরিপার্শ্ব নিয়ে মাথা ঘামাবে না, সোচ্চার ও সক্রিয় হবে না, এমনটা ভাবা অবাস্তব ও অবাঞ্ছনীয়। কিছু উচ্চাভিলাষী ছাত্র স্বেচ্ছায় ও পিতামাতার তাগিদে যে ভাবে কেরিয়ারের কারাগারে বন্দি হয়, সেটা তাদের পক্ষেও চরম ক্ষতিকারক, সমাজের পক্ষেও। দীর্ঘ শিক্ষকজীবনে অনেক খোকাখুকুর এ হেন মানসিক রক্তাল্পতায় উদ্বিগ্ন হয়েছি।
যে সময়ে ছেলেমেয়েরা কলেজে ঢোকে, সুকান্তের কবিতার সেই দুঃসহ দুর্বার বয়সে, পরিপার্শ্বের সঙ্গে প্রথম স্বাধীন সম্পর্ক ও আদানপ্রদান ঘটতে থাকে, সমাজবোধের উন্মেষ ঘটে, শৈশবের বোবা অন্যায়বোধ পরিস্ফুট হয়, প্রতিবাদের প্রত্যয় জন্মায়। |
সমাজের সঙ্গে নিজের সত্তার বোঝাপড়ার ভিত গড়তে সময়টা তাই এত গুরুত্বপূর্ণ।
এই বহিঃচেতনা ও সমাজবোধকে রাজনীতি বললে ভাবের ঘরে পুকুর চুরি হয়। ম্যাজিশিয়ানের হাতসাফাইয়ে যেমন হাজার টাকার নোট পরিণত হয় বাজে কাগজের টুকরোয়, ‘রাজনীতি’র নামে শুরু হয়ে যায় একেবারে ভিন্ন এক খেলা, সেটারও আখ্যা দিতে আর কোনও শব্দ অভিধানে নেই। এই কারচুপিই দলীয় রাজনীতিকদের উপজীব্য। শোনা যায় এক বিগত নেতার ভাষায় নেতৃকুলের আস্ফালন: ‘রাজনীতি ছাড়া কিছু হয় না কি?’
অতএব তরুণতরুণীদের অভীষ্ট রাজনৈতিক চেতনা, যার কথা পার্থদা বলছেন, মিলিয়ে যায় দলীয় হানাহানির হিংসা-ধ্বংস-কুৎসা-আগ্রাসনে। তারা স্লোগানের বর্ম এঁটে বিদ্বেষ ও হিংসার চর্চা করতে শেখে। যৌবনের স্বাভাবিক মানবিকতা ও সমাজচেতনা মাঠে শুকিয়ে যায়। সেই সঙ্গে পাঠ্যবস্তুর মধ্যে সমাজের উপকারী যে উপাদান, তাও হারিয়ে যায় অবহেলার গহ্বরে।
এই ছেলেমেয়েরা বোকা নয়, অন্ধ নয়। তবু যে তারা এই আবর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তা ক্ষমতাবান বয়স্ক সমাজের ষড়যন্ত্রে। চোখ মেলতেই তারা দেখে, দাবি মেটাবার বা অন্যায়ের প্রতিকারের নির্দিষ্ট পথগুলি রুদ্ধপ্রায়। আরও দেখে, সাধারণ মানুষের নাগরিক সত্তার মর্যাদা নেই, ন্যূনতম অধিকার পেতেও দল বেঁধে হামলা করতে হয়। সুতরাং তারাও যে একটা দলে ভিড়বে, আশ্চর্য কী? দলীয় গোষ্ঠীগুলিই যে এ অবস্থার জন্য দায়ী, দলের খাতায় নতুনদের নাম লিখিয়ে তারাই এটা চিরস্থায়ী করছে, সেটা বুঝতে সময় লাগে। তত দিনে ছেলেমেয়েরা বুঝে যায় আরও মর্মান্তিক সত্য তাদের নিস্তারের পথ নেই, জীবনে করে খেতে গেলে দলের পরিচয় ভাঙিয়েই তা করতে হবে। সুযোগ বুঝে দল বদলানো চলে, দলীয় ব্যবস্থাটা পাল্টানো যায় না।
ছেলেমেয়েরা যে শিক্ষাব্যবস্থা থেকে অন্য রকম চেতনা লাভ করতে পারত, এই ছেলেমেয়েদেরই হাতিয়ার করে সেই শিক্ষাব্যবস্থা পঙ্গু করে রাখে দলবাজ বয়স্কেরা। এদের মধ্যে শিক্ষকদের একাংশ অবশ্যই আছেন: সরাসরি দল করেন অপেক্ষাকৃত কম, দলের স্নেহচ্ছায়ায় প্রকৃত শিক্ষাদান থেকে বিরত থাকেন অনেক বেশি।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণিত শিক্ষা-রাজনীতির সঙ্গে এই চিত্রের কতটা মিল? পার্থদা বিদেশের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু তুলনা করেছেন। পশ্চিমি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি মোটেই সব সময় শুভ ও সুস্থ নয়। তার চূড়ান্ত প্রমাণ ষাটের দশকে পশ্চিমি দুনিয়া জুড়ে শিক্ষাপ্রাঙ্গণে বিশৃঙ্খলা, হিংসা, মৃত্যু। পার্থদাও সেই পুরনো নজির টানেননি, বরং তুলে ধরেছেন সাম্প্রতিক মার্কিন ছাত্র-রাজনীতির সংযত ও গঠনমূলক দিকগুলি।
এটা আমাদের অর্থে ছাত্র-রাজনীতি কি না প্রশ্ন উঠতে পারে, কারণ এ ক্ষেত্রে ছাত্রেরা যদি-বা দলবদ্ধ হয়ে কিছু করে, পালবদ্ধ হয়ে করে না। মনে করার যথেষ্ট কারণ থাকে, প্রত্যেক ছাত্র মোটের উপর নিজের হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, হয়তো তা মিলে যাচ্ছে আরও কিছু লোকের সঙ্গে। রাজনৈতিক দলগুলি অবশ্যই শিক্ষাপ্রাঙ্গণে প্রচার চালায়, কিন্তু তা ব্যক্তিমুখী ও মোটের উপর নিরুত্তাপ। মিটিং-মিছিল অবশ্যই হয়, কিন্তু পঠনপাঠনের নির্ঘণ্ট বিঘ্নিত হয় না, অবরোধ আর শব্দদূষণে মনঃসংযোগ ছারখার হয় না। প্রায় সব আন্দোলনই হয় প্রতীকী পদ্ধতিতে। বৃহত্তর উপলক্ষে, যেমন পার্থদার উল্লেখিত ওবামার নির্বাচনে বা ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনে, ছাত্ররা অন্যত্র গিয়ে শামিল হয়, শিক্ষাপ্রাঙ্গণ তোলপাড় করে না। হিংসা-ধ্বংস ঘটে কদাচিৎ। যদি ঘটে, তার মোকাবিলা সচরাচর হয় সাধারণ আইন মোতাবেক, প্রায়ই কড়া ভাবে।
সত্যি বলতে কী, ও-সব দেশের শিক্ষাপ্রাঙ্গণে অনেক বেশি, কখনও-বা ভয়াবহ মাত্রায় ঘটে অরাজনৈতিক অপরাধ: উদ্দেশ্যহীন খুন-জখম-আক্রমণ, লুটপাট ও ‘মাগিং’, ধর্ষণ ও নারীনিগ্রহ। আমাদের প্রাঙ্গণগুলি এ দিক দিয়ে অনেক বেশি সুস্থ, নিরাপদ। বলতেই হয়, সেখানে অশান্তি ও অরাজকতার বৃহত্তম (প্রায় একমাত্র) কারণ দলীয় রাজনীতি।
তাই প্রশ্ন, সচেতন মননসমৃদ্ধ সমাজচর্চার দোহাই পেড়ে এই চিন্তাবর্জিত রেষারেষি হানাহানির হয়ে সওয়াল করা যায় কি? দু’টি কি সমাজধারার বিপরীত মেরুতে অবস্থিত নয়? দ্বিতীয়টি কেবল প্রথমটির বিকৃত বা আতিশয্য নয়, শত্রু ও বিনষ্টকারী? পার্থদার কেন, আমাদের সকলের কাঙ্ক্ষিত ছাত্রদের রাজনৈতিক অধিকার কি তাতে রক্ষিত হচ্ছে?
এখানে বৃহত্তর রাজনীতির সঙ্গে তুলনা টানা হয়, তা নিয়েও ভাবা দরকার। লোকসভা-বিধানসভা ভোটে দেদার খুন-দাঙ্গা-নোংরামি হয়, তবু আমরা মনে করি, এত অনাচার সত্ত্বেও আখেরে ওই নির্বাচনে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষিত হচ্ছে। তার কারণ, ওই প্রক্রিয়াতেই আমাদের সরকার নির্বাচিত হয়, রাষ্ট্রিক জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়। শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্র-নির্বাচনের এমন কোনও নির্ধারক বা পরিচালক ভূমিকা নেই। তার উদ্দেশ্য দু’টি। এক, ছাত্রজীবন সংক্রান্ত মত দাবি প্রস্তাব তুলে ধরা, যার অন্য প্রত্যয়িত উপায় আছে। দুই, ভবিষ্যতের জন্য ছাত্রদের গণতান্ত্রিক চেতনা গড়ে তোলা। আজ এই মাটিতে দ্বিতীয় লক্ষ্যটি কি স্বপ্নবিলাসের বাড়া কিছু?
যে দিন পার্থদার প্রবন্ধ পড়লাম, ঘটনাচক্রে সে দিন থেকেই শুরু হল দুই বিপক্ষীয় ছাত্র-সংগঠনের পাল্লা দিয়ে উৎকট হানাহানি। এতে যুবসমাজের মূল্যবোধ বিকশিত হল? যারা নষ্টামি পাকিয়ে এখন দায় ঝেড়ে ফেলার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, তাদের দ্বারা সমাজের ছোটবড় কোনও উপকার সাধিত হবে কি?
পার্থদা অবশ্যই তা বলছেন না, বরং ছাত্র-রাজনীতির দলায়ত্ত বিকার নিয়ে তিনিও চিন্তিত। মুশকিল হল, বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা সেই বিকার বেমালুম অস্বীকার করছেন, করেই যাবেন। সেটা আন্তরিক বিশ্বাস না ভণ্ড আস্ফালন, সে বিচারে যাব না, মোদ্দা ফল একই। যেহেতু তাঁদের ঘোষণা মতো তাঁরা আদর্শ রাজনীতি করছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মননশীল উক্তি শেষ অবধি সেই দুর্বৃত্তায়নের সার্টিফিকেট হয়ে দাঁড়াবে মাত্র।
‘উপায় বনাম উদ্দেশ্য’ নিয়ে দার্শনিক কচকচির শেষ নেই, কিন্তু আদর্শের ইচ্ছাবিলাস চরিতার্থ করার জন্য চরম ও প্রকট ভাবে আদর্শহীন একটা ব্যবস্থা সমর্থন করা যায় না। যুবসমাজের সামাজিক বোধ ও কর্মোদ্যম ফলপ্রসূ করার ঠিক রাস্তা বার করতে সময় লাগবে। কিন্তু যে চোরা গলিতে দাঁড়িয়ে আছি, তা থেকে বেরিয়ে এলেই মঙ্গল। |