পাঁচিল দিয়ে ঘেরা চত্বরে প্রায় গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে সারি সারি বাড়ি। তিন-চার বা পাঁচতলা এই সব বাড়িতে নানা মাপের, নানা ধরনের অফিস বা উৎপাদনকেন্দ্র। খাস কলকাতার সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি এই শিল্পতালুকে আগুন নেভানোর ন্যূনতম ব্যবস্থাটাই নেই। শুধু কসবার এই তালুকই নয়, শহরের ১২টি সরকারি শিল্পতালুকের প্রায় কোনওটিতেই মানা হচ্ছে না আধুনিক অগ্নিবিধি। শহরে কোনও বড় অগ্নিকাণ্ড হলে কিছু দিন হইচই হয়। কিন্তু শিল্পতালুকগুলির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এখনও পড়ে রয়েছে সেই মান্ধাতার আমলেই।
অগ্নিবিধি না-মানায় দমকল দফতর বিভিন্ন শিল্পতালুকের বেশ কিছু কারখানার ছাড়পত্র (এনওসি) আটকে দিয়েছে। সেই কারণে ওই সব সংস্থা পুরসভা থেকে ট্রেড লাইসেন্সের পুনর্নবীকরণ করাতে পারছে না। এই অবস্থায় মুশকিল-আসানের পথ খুঁজতে সম্প্রতি দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে রাজ্যের প্রশাসনিক স্তরে।
কসবার তালুকে গিয়ে দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি বাড়িতে যাতায়াতের একটিই মাত্র পথ। বাণিজ্যকেন্দ্রের মাপকাঠিতে ওই পথ অতি অপরিসর। আগুন লাগলে বাড়ির বিভিন্ন তলের কর্মীরা পালাতে গিয়েও সঙ্কটে পড়বেন। জামাকাপড় থেকে কেক-মিষ্টি, হস্তশিল্প থেকে বৈদ্যুতিন সামগ্রী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য এই সব শিল্পতালুকে জায়গা বরাদ্দ করেছে রাজ্য ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়ন নিগম (ডব্লিউবিএসআইডিসি)। পরবর্তীকালে দফায় দফায় এই সব শিল্পতালুকে যুক্ত হয়েছে ব্যাঙ্ক-সহ অন্যান্য সংস্থার অফিসও। |
কসবা, বেলেঘাটা, উল্টোডাঙা, তারাতলা, খিদিরপুর, ট্যাংরা, এন্টালি, ফিয়ার্স লেন শহরে এমন মোট ১২টি শিল্পতালুক আছে। এই সব তালুকের একটিতেও কখনও অগ্নি-মহড়া হয় না। নেই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অগ্নি-প্রতিরোধ অফিসারও। এমনকী, লালবাজার ও মহাকরণের ঢিল ছোড়া দূরত্বে ডব্লিউবিএসআইডিসি-র সদর দফতরের অগ্নি-সতর্কতা নিয়েও ক্ষোভ জানিয়েছে দমকল দফতর। ওই দফতরের এক পদস্থ অফিসার বলেন, “পাঁচতলা বাড়িটিতে পর্যাপ্ত জলের আধার নেই। নেই বিকল্প সিঁড়িও। ওই বাড়ি ও অন্যান্য শিল্পতালুকের অগ্নিবিধি মানা নিয়ে আমরা ডব্লিউবিএসআইডিসি-কে বারবার সতর্ক করেছি।” তাতে বিশেষ কোনও ফল কোথাও হয়নি বলে মন্তব্য করেন ওই অফিসার।
সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন ডব্লিউবিএসআইডিসি-র চেয়ারম্যান, তৃণমূল নেতা সব্যসাচী বাগচী। বললেন, “এই ঘরে এসে দমকল-কর্তারা জানিয়ে গিয়েছেন, এগুলি কতটা বিপজ্জনক হয়ে আছে। কিন্তু আমি তো সবে দায়িত্ব নিয়েছি!” নিজের অফিস-ঘরের পিছনের একটি অংশ দেখিয়ে বলেন, “ঠিক করেছি, এখান দিয়ে বিকল্প সিঁড়ি তৈরি করব। এখানে জলাধার বানাব কী করে? ১৯৭৪ সালের বাড়ি এটি। জায়গা কোথায়?” কসবা তালুকের এক উদ্যোক্তা বলেন, “কারখানাগুলি কাজ শুরু করেছে সাতের দশকের গোড়া থেকে। সরকার অগ্নি-নির্বাপণের ন্যূনতম পরিকাঠামো করে দেয়নি। এখন এই পরিকাঠামো ঢেলে সাজা খুব মুশকিল।” তাঁরা ব্যবসার নানা ক্ষেত্রে দমকলের ছাড়পত্র না পাওয়ায় সমস্যায় পড়ছেন বলেও ক্ষোভ জানান ওই উদ্যোক্তা। আর এক উদ্যোক্তা বলেন, “বিষয়টি আমরা নেতাদের এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জানিয়েছি। তাঁরা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।”
কী ভাবে সমাধান সম্ভব? দমকলমন্ত্রী জাভেদ খান বলেন, “আমাদের অফিসারদের নিরন্তর চাপে গত কয়েক মাসে বিভিন্ন তালুকে অগ্নি-সতর্কতার বেশ কিছু কাজ হয়েছে। ট্রেড লাইসেন্স পুনর্নবীকরণের ব্যাপারে পুর-কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি।” বকেয়া কাজগুলি দ্রুত করার ব্যাপারে ডব্লিউবিএসআইডিসি-কে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাভেদ। কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “এই সমস্ত শিল্পতালুকে অগ্নি-বিধি যথাযথ ভাবে মেনে চলার ব্যাপারে দমকলবাহিনীর চাপ আছে। সেটা মাথায় রেখে আটকে থাকা ট্রেড লাইসেন্স পুনর্নবীকরণের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।”
শহরের বিভিন্ন শিল্পতালুকে অগ্নি-বিধি নিয়ে সতর্কতা প্রসঙ্গে ডব্লিউবিএসআইডিসি-র চেয়ারম্যান বলেন, “এতকাল তালুকগুলির অগ্নি-নিরাপত্তার দিকে বিন্দুমাত্র নজর দেওয়া হয়নি। রাতারাতি নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা কী ভাবে করা সম্ভব?” তিনি জানান, আপাতত কলকাতার ছ’টি তালুকে অগ্নি-নির্বাপণের বিশেষ ব্যবস্থা হচ্ছে। সরকারি পরামর্শদাতা সংস্থা ‘ওয়েবকন’-কে দিয়ে এ ব্যাপারে সমীক্ষা করানো হয়েছে। সব্যসাচীবাবু বলেন, “ন’কোটি টাকার একটি প্রকল্প সরকার অনুমোদন করেছে। টেন্ডারের পরে বছর দেড়েক লাগবে কাজগুলি করতে।” কী কাজ? তাঁর বক্তব্য, “বেহালার তালুকে তিনটি জলাশয় আছে। ওই জল তালুকের বিভিন্ন কারখানায় জোগানের জন্য রিং পাইপ বসানো হবে।” কসবা তালুকে রাস্তা খুঁড়ে ভূগর্ভে জলাধার তৈরির পরিকল্পনা হয়েছে বলেও জানান তিনি। |