আলাপ-আলোচনা চলছিলই। প্রেসিডেন্সির ঘটনার পরে এ বার আরও বেশি করে ছাত্র রাজনীতিকে দলতন্ত্র মুক্ত করার কথা ভাবছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্সিতে তৃণমূল ছাত্র সংগঠন গড়া আটকে দিয়েছেন তিনি।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক ভাঙচুরের ঘটনায় যে তিনি কতটা দুঃখিত এবং মর্মাহত, তা বারবারই বলেছেন মমতা। দোষীদের যে কোনও ভাবেই রেয়াত করা হবে না, সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনীদের প্রতিবাদ মিছিলে তিনিই ব্রাত্য বসুকে সামিল হতে বলেছিলেন বলেও জানান মমতা। এ বার একান্ত কথাবার্তায় মমতা পরিষ্কার বলে দিলেন, যদি এক জন তৃণমূল কর্মীরও জড়িত থাকার ঘটনা প্রমাণ হয়, তাঁকে শাস্তি পেতে হবে। শুধু তা-ই নয়, রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের কথার প্রতিধ্বনি করে তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে কোনও দলই যাতে এ ভাবে তাণ্ডব না করতে পারে, তা আমি সুনিশ্চিত করব।”
কী ভাবে সেটা সম্ভব হবে?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতিকে সার্বিক ভাবে রাজনৈতিক দলতন্ত্রের প্রভাবমুক্ত করার জন্যই উদ্যোগী হতে চান মমতা। কলেজে কলেজে ছাত্র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্রমান্বয়ে হিংসার পরিপ্রেক্ষিতে এমন একটা ভাবনার কথা এর আগে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন। সংবাদমাধ্যমে কলম ধরেছেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন। এ বার মুখ্যমন্ত্রী নিজে বুঝিয়ে দিলেন, বিষয়টি নিয়ে কতটা আন্তরিক তিনি। এবং এই কঠিন কাজটা মমতা প্রেসিডেন্সি থেকেই শুরু করতে চান। যে কারণে, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনও ছাত্র সংগঠন গড়তে দেননি তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, প্রেসিডেন্সিতে দু’টি ছাত্র সংগঠন রয়েছে। “এ বারে যখন নির্বাচন হয়েছিল, তৃণমূলের ইউনিয়নের প্রস্তাব এসেছিল। আমি সেটি করতে দিইনি। কারণ, প্রেসিডেন্সি একটি উৎকর্ষ ও মেধার জায়গা।” |
ফেরা। হাসপাতাল থেকে বাড়ি যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। শনিবার সন্ধ্যায়। ছবি: সুদীপ আচার্য |
সম্প্রতি বেঙ্গালুরু গিয়েছিলেন মমতা। সেখানে তিনি দেখে এসেছেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিয়নে রাজনৈতিক দলের প্রবেশ নেই। ভারতের বেশ কিছু রাজ্যেই এই মডেল চলছে। পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান হানাহানির মধ্যে দাঁড়িয়ে এখানেও ছাত্র রাজনীতিকে দলতন্ত্রমুক্ত করা যায় কি না, তা নিয়ে সর্বস্তরে আলোচনা চাইছেন মমতা। চাইছেন, রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা বর্জন করে ছাত্র সংসদ গড়ে তোলা যায় কি না, তাই নিয়ে কথাবার্তা হোক। তাঁর মতে, ৩৪ বছরের সিপিএম শাসনে এ রাজ্যে ছাত্র রাজনীতির যে ঘরানা জাঁকিয়ে বসেছে, সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বদল আনতে হবে। তিনি বলছেন, “ছেলেমেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে আসবেন, চাকরির সন্ধান করবেন, বাবা-মা নিশ্চিন্ত থাকবেন এমন পরিবেশ কী ভাবে গড়ে তোলা যায়, সকলের সঙ্গে সে বিষয়ে আলোচনায় রাজি আমি।’’
মমতার আলোচনা-প্রস্তাবে আপত্তি নেই বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রেরও। বললেন, “আলাপ-আলোচনা, মত বিনিময়ে আমরা সব সময় রাজি।” তবে ছাত্র রাজনীতিকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করাটা কতটা বাস্তবসম্মত এবং যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান। সূর্যবাবুর প্রশ্ন, ১৮ বছর বয়সে যেখানে মানুষ ভোটাধিকার পেয়ে যায়, সেখানে তাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখাটা কী করে সমর্থনযোগ্য হয়? তা ছাড়া তাঁর মতে, অন্যান্য রাজ্যে যেখানে অরাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন রয়েছে, সেগুলো কেবল আপাত ভাবেই অরাজনৈতিক। সূর্যবাবু মনে করিয়ে দেন, “পঞ্চায়েত মন্ত্রীদের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওকে আমি এক বার এই কথাটা বলেছিলাম। উনি পঞ্জাবে অরাজনৈতিক পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সাফল্যের কথা বলছিলেন। আবার সেখানেই পঞ্চায়েতের অনুদান কাজে লাগানোর কৃতিত্ব কংগ্রেসকে দিচ্ছিলেন। দু’টো এক সঙ্গে কী ভাবে সম্ভব? অরাজনৈতিক সংগঠন ব্যাপারটা আসলে ভুয়ো।” তবে তাই বলে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলগুলির দখলদারি যে কমা উচিত, সেটা অস্বীকার করেননি সূর্য। বললেন, “প্রাথমিক ভাবে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের ঢোকা বন্ধ করা যায় কি না, সেটা ভাবা যেতে পারে।”
বস্তুত এ রাজ্যে রাজনৈতিক নেতারা অধিকাংশই ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন। মমতা নিজেও তাঁর ব্যতিক্রম নন। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপটে ছাত্র রাজনীতি তথা সার্বিক ভাবে রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার নিরিখেই একটা রূপান্তরের কথা ভাবতে হচ্ছে মমতাকে। তাঁর মতে, পশ্চিমবঙ্গে গত ৩৪ বছর ধরে সিপিএম ছাত্রদের নিয়ে লাগামছাড়া রাজনীতি করেছে। তার আগে নকশাল আন্দোলনে বহু ছাত্র-ছাত্রীর প্রাণ গিয়েছে। সম্প্রতি রাজ্য ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রেকর্ড থেকে জানা যাচ্ছে, এখনও প্রতি মাসে গড়ে ১০০টি রাজনৈতিক হিংসার ঘটনা ঘটছে। ২০১১ সালের ১৩ মে থেকে ২০১১ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্তও দেখা যাচ্ছে, ছাত্র রাজনীতির হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে ৬৪২টি। তার মধ্যে ২৭ জন নিহত হয়েছেন। ৯২৬ জন আহত হয়েছেন। তার মধ্যে ১২৮ জন ছাত্র।
এই পটভূমিতে দাঁড়িয়েই মমতা বলছেন, “যে কোনও ধরনের হিংসার বিরুদ্ধে আমি। সেই হিংসা যদি তৃণমূল কর্মীরাও করেন, তবে সেই হিংসাটা নির্দোষ হয়ে যায় না।” কিন্তু তাঁর বক্তব্য হল, পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার ‘জনক’ যদি কেউ থেকে থাকে, সেটা সিপিএম। তিনি মনে করাচ্ছেন, ১৯৬৬ সালেও প্রেসিডেন্সির রসায়ন গবেষণাগারে ভাঙচুর করেছিল সিপিএম। দু’বছর আগে ফের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটায় তারা। মমতার দাবি, হিংসাশ্রয়ী রাজনীতির যে ঘরানা সিপিএম আমদানি করেছিল বিরোধী দল হিসেবে, শাসন ক্ষমতায় আসার পরে ৩৪ বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে সেই হিংসার রাজনীতিই চালিয়ে গিয়েছে। স্কুলের বাচ্চাদের মিছিলে নিয়ে এসেছে। তাদের দিয়ে পতাকা বইয়েছে। দলীয় রাজনীতির নিরিখে শিক্ষক থেকে উপাচার্য নিয়োগের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “৩৪ বছরের এই পাপ আমি দেড় বছরে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেব, সেটা বলা অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক। আমি চাইছি, বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক হোক।” মমতার এই কথার প্রেক্ষিতে সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য সীতারাম ইয়েচুরির তির্যক মন্তব্য, ‘‘পাপ সাফ হবে কী! পাপ তো বেড়েই চলেছে!”
মমতা কিন্তু আপাতত একটা কথাতেই বারবার জোর দিচ্ছেন তাঁর উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় ‘নেগেটিভ’ নয়। রাজ্যে উন্নয়ন ও শিল্পায়ন ঘটানো, বিনিয়োগ টানাই এখন তাঁর অগ্রাধিকার। “আমি ভগবান নই। তবে গত দেড় বছরে রাজ্যের উন্নয়নে
আমি অনেক কিছু করেছি। সেটা করতে গিয়ে একশোটা কাজের
মধ্যে যদি কয়েকটা ভুল হয়ে থাকে, তবে তা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই সংশোধন করব।”
কিন্তু উন্নয়নের জন্য রাজ্যকে রাজনৈতিক হিংসামুক্ত করা যে কতটা দরকার, তা এখন প্রতি পদে অনুভব করছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্ট বলছে, গত ৩০ বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক হিংসার প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষে। লালকৃষ্ণ আডবাণী যখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তখন ডিজি সম্মেলনে রাজ্যওয়াড়ি হিংসা এবং সংঘর্ষের একটি রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছিল। তাতে জানা গিয়েছিল, সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত হিংসা-সংঘর্ষের ঘটনা উত্তরপ্রদেশে ও বিহারে সবথেকে বেশি। কিন্তু রাজনৈতিক হিংসায় পশ্চিমবঙ্গ প্রথম। সম্প্রতি সুশীল কুমার শিন্দের মন্ত্রকও যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতেও পশ্চিমবঙ্গ ‘ফার্স্ট বয়’।
অনেক হয়েছে। রাজনৈতিক হিংসায় রাজ্যকে এ বার একেবারে পিছনের বেঞ্চিতে পাঠাতেই উঠেপড়ে লেগেছেন মমতা।
|