চৈত্রমাসে কবিরা যতই প্রেয়সীর চোখে নিজের সর্বনাশের আভাস দেখে পুলকিত হয়ে উঠুক না কেন, ঘরে ঘরে ঘরণীদের হাতে এ সময় সম্মার্জনীই দেখা যায় বেশি।
আহা! কী মনোরম এই শেষ বসন্তের বেলা! কোকিল কু-উ কু-উ করছে, দুপুর দুটোয় ঘুঘু ডাকছে ঘুম-ঘুম ঘুম-ঘুম, কাকবউটি ভেবে চলেছেতিনটে ডিম পেড়েছিলাম, না চারটে! ডাগর আম ঝুলছে গাছে গাছে যেন অগুনতি সবুজ রঙা বাংলার পাঁচ! ডানপিটেরা পকেটে ঢিল গুলতি নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে আম চুরি করতে। এ চুরি তো চুরি নয়, এ হল যুদ্ধজয়ের গর্ব। কার টিপ কত ভাল, তারই পরীক্ষা হয়ে যায়। গুলতি ধরো, ঢিল নাও, তাক করোথপাস! ঠিক জায়গায় লাগলেই একেবারে বোঁটাশুদ্ধ খসে পড়বে। যাদের এমন সাহস নেই, তারা বিধুর আকাশের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে কবে কালবৈশাখী আসবে। ঝড়ে আম পড়বে। চোখে ধুলো ঢুকে কড়কড় করবে, জিভে বালু কিচকিচ। আর ওই ধুলোবালি খেতে খেতেই আম কুড়িয়ে কোঁচড়ে তুলে দে দৌড়!
চৈত্রমাসে শুধু কবির কেন, আমগাছের মালিকেরও কম সর্বনাশ হয় না। |
চৈত্রবৈশাখী ওই ঝড়ও কিছু কম দস্যি নয়। ক্রীড়াকৌতুকে, হাওয়ার ঝাঁটা বুলিয়ে, মাঠ ঘাট গাছপালা থেকে চৈত্রের যত সৃষ্টিছাড়া ধুলো উড়িয়ে সে খল খল করে হাসতে হাসতে চলে যায়। তার মাতনে এমন এক উড়িয়ে দেওয়ার নেশা যে ঘরে ঘরে বউরা সব ঝাঁটাহস্তেন সংস্থিতা! সেই যে শরতে শেষ বৃষ্টি হয়েছিল, তারপর হেমন্তে শরৎবিদায়ের বিষাদ, শীতে কেবল কুঁড়েমি লাগত, আর খাই-খাই ভাব। নতুন চালের পায়েস, পিঠে, পুলি! চাষি-বউ হলে তো কথাই নেই। সারাদিন ধান ঝাড়া, সেদ্ধ করা, শুকোন, গোলায় ভরাহাজার কাজে খেয়ালই থাকে না কোন খাটের তলায় মাকড়শার জাল, কোন আলমারির পেছনে টিকটিকির বাসা আর আনাচে-কানাচে ধুলোর সঙ্গে চুলের জটের জঞ্জাল!
অতএব, ঝাঁটা হাতে মেয়েদের তখন দেখায় অসি হাতে ঝাঁসির লক্ষ্মীবাঈয়ের মতো। টুঁ শব্দ করবে, এমন উপায় থাকে না পুরুষের। অ্যাই, আলমারিটা সরিয়ে দাও তো। খাটটা টানো না। লেপ তোশক বালিশউঠোনে সব রোদ্দুরে দাও দিকি! লাঠিপেটা করো। বাপরে! কী ধুলো! ঝ্যাঁটা বুলোন চলতে থাকে সব জায়গায়। শুধু আরশোলা ইঁদুর টিকটিকি কেন, হাতি গণ্ডার থাকলেও পার পাবে না! সেইসঙ্গে দুপুরে জুটবে সেদ্ধভাত। কী করব? আজ ঘর ঝেড়েছি না? বৈশাখের গিন্নি যদি বৈশাখী ঝটিকা হয়সেও নিশ্চয়ই এমনি করেই বলে।
ঝোড়ো ঝ্যাঁটানির পর যেমন শান্ত হয়ে আসে প্রকৃতি, তপ্ত বায়ু স্নিগ্ধ হয়, তেমনি পয়লা বৈশাখ। ফাল্গুনী বসন্ত পলাশে শিমুলে মাতিয়ে রেখেছিল। আমের বোলের গন্ধে তার বাতাস ছিল আমোদিত। শীতে যত পাতা ঝরার নিঃস্বতা, ভরিয়েছিল নবপল্লবদলে। এবার ফল ফলানোর পালা। হিসেবের নতুন খাতায় নম গণেশায় বলে ফুল-চন্দন ছিটিয়ে পুরুতঠাকুরের পকেট ভরানোর পালা। নতুন সবুজ পাতার সঙ্গে নতুন হালখাতা। এক বছরের যত ময়লা সরে গিয়েছে ঝড়ে। উড়ে গিয়েছে ঝাড়ু বুলোনর দক্ষ কারসাজিতে। আজ সিঁদুরের ফোঁটা পড়ছে দুয়ারে। বসুধারার মতো মঙ্গল ঝরে পড়ুক সংসারে। আজ পরনে নতুন শাড়ি, নতুন জামা, নিদেন নতুন লুঙ্গি একটি। আজ মিষ্টিমুখের দিন।
যত জাতি রয়েছে এ দেশে, সবার আছে নিজস্ব বর্ষপঞ্জী। প্রকৃতির রূপে রসে মিলিয়েই তার নতুন বছর। কেজো জগতে পয়লা জানুয়ারির যতই দাপট থাক, তিথি-নক্ষত্রর অঙ্কে ভরা দেশজ পঞ্জিকার বিক্রি এতটুকু কমেনি। জীবনযাত্রা অনেক পাল্টে গিয়েছে। তবু চারপাশের প্রকৃতিতে নিজস্ব যে রূপের খেলা তা ভুলবে কী করে মানুষ! |