শনিবারের নিবন্ধ ২...
আবার বছর বাইশ পরে
হারিয়ে যাওয়া সেই উজ্জ্বল অতীতকে এ ভাবেও ফিরিয়ে আনা যায়!
নববর্ষের সকালে বাংলা গানের সেই জলসাকে ঘিরে একদা গোটা বঙ্গসমাজ আন্দোলিত হত। আজও বয়স্কদের আড্ডায় ভেসে ওঠে বাইশ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া নববর্ষের সকালের সেই সোনালি অনুষ্ঠানের নানা টুকরো স্মৃতি।
কিন্তু তার আর প্রয়োজন নেই বোধহয়। চার দশক ধরে প্রতি নববর্ষের সকালে যে-অনুষ্ঠান যেখানে চলতে চলতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, মন্টু বসুর সেই বসুশ্রী প্রেক্ষাগৃহেই ফের শুরু হচ্ছে বর্ষবরণ উত্‌সব। ‘বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন সমিতি’র চার জন নিরলস সদস্যের অনেক দিনের বাসনা ছিল সেই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা।
“এত দিনে তা সফল হল। নববর্ষের সকালে বাংলা গানের সোনালি দিনের শিল্পীদের পাশাপাশি গান গাইবেন এই প্রজন্মের শিল্পীরাও”, জানালেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক গায়ক সলিল মিত্র, সম্পর্কে যিনি গায়ক প্রয়াত শ্যামল মিত্রের ভাই।
দ্বিজেন মুখোপাধ্যয়, আরতি মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র বা সলিল মিত্রের পাশাপাশি গায়কদের তালিকায় রাখা হয়েছে ইন্দ্রাণী সেন, বনশ্রী সেনগুপ্ত, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্ল, পূর্ণদাস বাউল, শিবাজি চট্টোপাধ্যায়, সৈকত মিত্র, ইন্দ্রনীল সেন, জোজো, কিঞ্জল চট্টোপাধ্যায় এবং দেবাত্রেয়ী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এ ছাড়া গায়ক-গায়িকা সহ মোট ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হবে স্মৃতি-স্মারক পুরস্কার। যেমন মন্টু বসুকে দেওয়া হবে উত্তমকুমার স্মৃতি-স্মারক পুরস্কার। জানালেন সমিতির সভাপতি সোমদেব বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলা নববর্ষ উদযাপন সমিতির এই নব উদ্যোগে শুধু শিল্পীরাই নন, একদা বাংলার বিনোদন জগতের প্রাণপুরুষ মন্টু বসুও কম উত্তেজিত নন। ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে এখনও বসুশ্রীতে তাঁর আসা চাই-ই। বললেন, “সেই ১৯৫০-এ হেমন্তদার উত্‌সাহেই শুরু করেছিলাম বর্ষবরণ উত্‌সব।”১৯৪৯ সালে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়ে হেমন্তবাবু মন্টু বসুর কাছ থেকে কত পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন জানেন? মাত্র ২৫ টাকা। “আর শচীন কর্তা আরও পাঁচ টাকা বাড়তি দাবি করেছিলেন।” ফেলে আসা দিনে ফিরে গিয়ে মন্টুবাবুর তখন ভগ্নশরীরের কথাও যেন মনে নেই। এখনও ঝকঝকে স্মৃতি। কী ভাবে সাজানো হবে মঞ্চ, প্রশাসনের কোন কোন দফতর থেকে অনুমতি আদায় করতে হবে, সমিতির সাধারণ সম্পাদক সলিল মিত্রকে সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দিলেন।
বালিগঞ্জ স্টেশন রোডে সমিতির দফতরে কাজের অন্ত নেই। দিনরাত কাজ চলছে। ব্যবস্থায় যেন কোনও খুঁত না-থাকে। শৈলেন মান্না স্মারক পুরস্কার নিতে চুনী গোস্বামী অস্বীকার করায় তড়িঘড়ি ফোন করে বিদেশ বসুকে রাজি করানো হল। বিদেশ আপ্লুত।
“পয়লা বৈশাখে বসুশ্রীর ওই সকালের অনুষ্ঠান আমাদের বুঝিয়ে দিত, এটাই আমাদের নববর্ষ”, দূরভাষে অকপট স্বীকারোক্তি বাংলা গানের স্বর্ণযুগের শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের। নতুন করে বসুশ্রীতে নববর্ষ শুরু হওয়ায় তিনি খুব খুশি।
বসুশ্রী প্রেক্ষাগৃহে মন্টু বসুর অফিসঘরে পঞ্চাশের দশক থেকেই আনাগোনা শুরু হয়েছিল তখনকার বাংলা শিল্প সংস্কৃতি এবং ময়দানের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। গায়ক-অভিনেতা-খেলোয়াড় সবার জন্য অবারিত ছিল মন্টুবাবুর দরজা। শিল্পী সংসদের অফিসঘর ছিল না। “এগারো বছর ধরে আমার এখানেই ছিল ওদের অফিস ঘর।”
প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, আলপনা গোস্বামী, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখ্যপাধ্যায়, বেলা মুখোপাধ্যায়,
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ভি বালসারা, শ্যামল মিত্র ও অন্যান্যরা
ভারতীয় চলচ্চিত্রে ‘ফিল্ম এগ্‌জিবিটর’ হিসেবে ২০১০-য়ে নির্মলকুমার বসুকে (মন্টু বসুর পোশাকি নাম) দাদাসাহেব ফালকে অ্যাকাডেমির তরফ থেকে স্মারক পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয় তাঁর অবদানের জন্য। দাদা শ্যামল মিত্রের হাত ধরেই বসুশ্রীর আড্ডায় প্রবেশাধিকার মিলেছিল সলিলবাবুর। “সকালবেলায় ভানুদা-জহরদা-দাদা-মানবদা আড্ডা দিতে চলে আসতেন বসুশ্রীতে।” মন্টুবাবু শোনালেন আর এক গল্প। এক সকালে ভানুদা-জহরদা এসেছেন আড্ডা দিতে। ঢুকেই চায়ের অর্ডার দিয়েছেন জহরদা। ‘আজকে চায়ের পয়সা দেবে জহর’, ভানুদা বার কতক এই কথা বলায় কৃত্রিম রাগে ফেটে পড়লেন জহরদা। চিত্‌কার করে ভানুদাকে বললেন, ‘ইস্টুপিড, ননছেন্স, আমি চায়ের পয়সা দিলে মন্টুকে অপমান করা হবে না? আমি চললাম। আচ্চা চা-টা খেয়েই যাই। বলেই ফের বসে পড়লেন।
“১৯৬৮-তে মান্না দে এখানে প্রথম গেয়েছিলেন। মান্নাদার গান বেশি করে শ্রোতাদের শোনার সুযোগ দেওয়ার জন্য মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় আর শ্যামল মিত্র একটিমাত্র ডুয়েট গান গেয়েছিলেন ‘দোলে দোদুল দোলে দুলো না’। গান গেয়ে উঠে যাওয়ার সময় শ্রোতাদের তাঁরা বলেছিলেন, আমাদের গান শোনার অনেক সুযোগ পাবেন, কিন্তু মান্নাদার নয়। এখন এ সব ভাবা যায়?” সলিলবাবুর কথায় ঘুরেফিরে উঠে আসছে অতীতের সোনালি স্মৃতি।
নববর্ষে নয়, ১৫ অগস্টে একবার এখানে গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল সুকুমার সমাজপতির। “তবলায় সঙ্গত করেছিলেন শ্যামল মিত্র।”
নববর্ষের সকালে ফের বসুশ্রীতে গান গাইতে পারবেন, জানার পরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আরতি মুখোপাধ্যায় আর নির্মলা মিশ্রের। “আনন্দের সীমা পরিসীমা নেই। তেরো বছর থেকে গান গাইছি। আমরা প্রতিমাদির পরের ব্যাচ। আমি, সবিতা, আরতি আর শিপ্রা বসু। তবে এ বারে শ্রোতারা যদি ‘ও তোতা পাখি রে শিকল খুলে উড়িয়ে দেব’ শুনতে চান, তবে গাইতে পারব কিনা সন্দেহ। এখন গাইতে গেলে চোখে জল আসে,” জানালেন নির্মলা মিশ্র।
উত্তমকুমার, শ্যামল মিত্র, প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি ও অন্যান্যদের সঙ্গে মন্টু বসু (বাঁ দিকে)
ষাট বা সত্তরের দশকে বসুশ্রী জলসার আলাদা আকর্ষণ ছিল আরতি মুখোপাধ্যায়ের কাছে। “সে একটা যুগ ছিল। প্রত্যেকের নিজস্ব আইডেন্টিটি ছিল। হেমন্তদা-মান্নাদা-শ্যামলদার সঙ্গে গান গাওয়ার সুযোগ পাব, ভাবতেই আনন্দ লাগত।” রেডিয়ো-তে শনি-রবি অনুরোধের আসর, ছায়াছবির গান অথবা রম্যগীতি ছিল শ্রোতাদের অত্যন্ত প্রিয়। “এখন তো একটা সাধারণ গান নিয়েও দেখি খুব হইচই হচ্ছে। গান গাইবার দক্ষতা নেই, সুর করার এবিলিটি নেই, গানের ভ্যালু নেই। গানকে রাগভিত্তিক করতেই হবে। তবে তা হৃদয় ছোঁবে।” আজকের শিল্পীদের মধ্যে আরতির পছন্দ লোপামুদ্রা মিত্রকে। তাঁর নিজস্বতা আর স্বকীয়তার প্রশংসা করলেন তিনি।
গায়ক হওয়ার অনেক আগে থেকেই নববর্ষে বসুশ্রীর জলসার গান শুনতে আসতেন শিবাজি চট্টোপাধ্যায়। “তবে হলের বাইরে দাঁড়িয়েই গান শুনতাম। এই ফাংশানের গ্ল্যামার ছিল আলাদা। কলকাতার অভিজাত পরিবারের মানুষজন এখানে ভিড় করতেন। শিহরন জাগাত উত্তমকুমারের উপস্থিতি।”
পরে এখানে একবারই গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর তবে সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। স্বর্ণযুগের বাংলা গানের শিল্পীদের সঙ্গে সারা জীবন কাটিয়ে আসা মন্টু বসু নববর্ষের সকালের এই জনপ্রিয় ফাংশান বন্ধ করে দিয়েছিলেন হেমন্তবাবু প্রয়াত হওয়ার পরে। বাইশ বছর পরে এ বারের নববর্ষের সকালে ‘কাহারবা না দাদরার’ সুরে সুরে শ্রোতাদের ভাসিয়ে দেওয়ার কাজে শিল্পীরা কতটা সফল হবেন, সময়ই তা বলতে পারবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.