|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ ১... |
ফুলমাসি নেই, রাঙাকাকা নেই, বড়মা নেই |
সেই ডাকগুলো কোথায় হারিয়ে গেল! তবু সময় তো থেমে থাকে না!
দরজায় দাঁড়িয়ে ১৪২০। ফিরে দেখলেন সমরেশ মজুমদার |
তখন সংসারে মায়া ছিল। যাবতীয় মনোমালিন্য, ঈর্ষা মাথা নামিয়ে নিত ওই মায়ার জন্যে। ওই কারণেই, হয়তো, বাড়িতে আসা নতুন বৌ জড়িয়ে যেতেন সবার সঙ্গে।
পনেরো, ষোলো জনের পাত পড়ত দু’বেলা, রান্নার লোকের হাতে থাকত না দায়িত্ব। ছেলেরা তো বটেই, মেয়েরাও নিজেরা রান্না না করলে তৃপ্ত হতেন না। তাঁদের যিনি প্রধানা, তিনি কার কী পছন্দ, কোনটা না-পছন্দ তার খবর রাখতেন। খেতে বসে দিব্যি টের পেতাম সেটা। বাড়ির ভেতরে পা দেওয়ার পর মা-পিসিরা প্রত্যেকের মনের ভেতরটা দেখতে পেতেন। বোধহয় ওই কারণেই অদৃশ্য মায়ার স্পর্শ পেতাম আমরা। এসব পঞ্চাশ কী ষাট বছর আগের কথা।
বাড়িগুলোর দুটো ভাগ ছিল। বাইরেটা ছেলেদের। কিন্তু বয়স্ক পিতামহ সেখানে অবস্থান করলে, তাঁর ছেলেদের গলা শোনা যেত না। ভেতরটা ছিল মেয়েদের রাজত্ব। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের সেখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধু আমরা যারা তখনও হাফ প্যান্ট ছাড়িনি, অবলীলায় ঢুকে পড়তাম। কিন্তু যেই নাকের নীচে কালচে রেখা ফুটল, অমনি চোখ ঘুরিয়ে ধমক দিতেন তাঁরা, “অ্যাই ছোঁড়া, এখানে কী শুনতে এসেছিস? যা ভাগ!” অথচ প্রবীণ কাজের লোকদের দেখেও তাঁরা দেখতেন না। যেন তাঁরা পুরুষ নন।
এই যে সংসার, যা বেশির ভাগ বাঙালির অভিজ্ঞতায় এখনও স্মৃতি হয়ে বেঁচে আছে, সেখানে কিছু কিছু মানুষ মাঝেমাঝেই আনাগোনা করতেন। এক বিকেলে বড় পিসিমা আমাদের মোয়া আর নারকোলের নাড়ু পরিবেশন করে মাথা দুলিয়ে হেসে বললেন, “কাল তোদের ফুলমাসি আসবে।” |
|
শোনা মাত্র পৃথিবীটা যেন ফাল্গুনের পলাশে রাঙা হয়ে যেত। ফুলমাসি মানেই কত নতুন কথা শোনার সুযোগ, ফুলমাসি মানেই কাননবালার গান। বড় পিসিমা আরও জানালেন, “তালুই মশাই ওকে পৌঁছে দিয়েই চলে যাবেন লিখছেন। এ কেমন কথা! মেয়ের বাড়িতে তে-রাত্তির না হোক, একটা রাত তো থাকতে পারেন।”
বড় পিসিমা যাঁকে তালুই মশাই বললেন, তিনি আমার দাদামশাই, মায়ের বাবা। চোদ্দো বছরে মাকে এই সংসারে পাঠিয়েছিলেন। বছরে একবার তিনি এসে মেয়েকে দেখে যান। অনুরোধে একটা রাত থাকেন। মা বাপের বাড়ি যান দু’বছরে একবার। তখন আমরা তাঁর সঙ্গী, আহা কী আনন্দ! ফুলমাসি মায়ের ছোট বোনদের একজন। তিনি যে নিজের বোন নন, মায়ের কাকার মেয়ে, তা বুঝতে পারিনি কৈশোর কালেও। বড় পিসিমা হেসে মাকে বললেন, “যে ক’দিন ফুল এখানে থাকবে, তদ্দিন তুই ওদের যত্নআত্তি করবি। নইলে ফিরে গেলে ওর মুখে কিছু শুনলে তোমার মা দুঃখ পাবেন।” মা বললেন, “ওইটুকুনি পুঁচকি মেয়েকে আবার কী যত্ন করব? আমরা যেমন আছি, তেমন থাকবে।”
তখন বড়, সেজ আর ছোটর মাঝখানে যিনি থাকতেন, তাঁকে ন’কাকা বলা হত কেন? কিন্তু স্বীকার করতেই হবে ডাকটায় একটা মোলায়েম মিষ্টিভাব জড়ানো থাকত। আবার দেখা যেত এই ন’কাকা বা ন’মামারা সংসারে তেমন গুরুত্ব পেতেন না অথবা নিতেও চাইতেন না। অনেকটা পাণ্ডবদের নকুলের মতো। আমার ন’কাকা ছিলেন খুব শান্ত প্রকৃতির। কলেজের পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন এবং প্রায়ই দেখতাম চুল আঁচড়াচ্ছেন। তাঁর দাদাদের অবাধ্য যেমন হতেন না, তেমনি ঘনিষ্ঠতাও দেখাতেন না। বিকেল বেলায় সেই ন’কাকা ইশারায় কাছে ডেকে বললেন, “শুনলাম তোর ন’মাসি আসছেন! খবরটা কি ঠিক?” মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। তিনি একটা শ্বাস ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। ফুলমাসি এর আগে যত বার এসেছে, ন’কাকাকে কথা বলতে দেখিনি। তা’হলে আজ ন’কাকা ওই ভাবে শ্বাস ফেলল কেন?
পরদিন রবিবার বাড়িতে সবাই। দাদামশাই নামলেন রিকশা থেকে। আমরা ছুটে গেলাম। ধুপ ধুপ করে পা ছোঁওয়া। রিকশায় বসে ফুলমাসি চোখ পাকালো, ‘অ্যাই, আমাকে প্রণাম করছিস না তোরা?” কে আগে প্রাণ করিবেক দান, বলে এগিয়ে যেতেই রিকশা থেকে লাফিয়ে নামল ফুলমাসি। তারপর দে দৌড়, দে দৌড়।
বাড়ির পাশের মাঠ পেরিয়ে ফুলমাসি ছুটছে। লম্বা বেণী পিঠের ওপর নাচছে, আমরা কয়েকজন তাকে ধরতে পারছি না। গাছগাছালি পেরিয়ে হঠাত্ থমকে দাঁড়িয়ে বুকে হাত রেখে ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে ফুলমাসি বলল, “আর না!” আমরা পা ছুঁতে যেতেই ঘাসের ওপর বসে পড়ে বলল, “একদম না। গতবার যে গানটা শিখিয়ে গিয়েছিলাম, তার মাঝখানের চারটে লাইন শোনা আগে।”
“কোন লাইন, কোন লাইন?” কলকলিয়ে উঠলাম আমরা।
“ওই যে ভাইয়ে-মায়ে।” মিটিমিটি হাসল ফুলমাসি।
“ভাইয়ে-মায়ে এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ।” গান না চিত্কার তাতে কী এসে যায়। হাত তুলে আমাদের থামিয়ে ফুলমাসি বলল, “আমার সঙ্গে গা।” আহা, বুক জুড়িয়ে গেল।
এখন পিছনে তাকালে ফুলমাসির মুখটা মনে আসে? ফুলমাসি কি সুন্দরী ছিল? গায়ের রং কি চাঁপার মতো? মনে পড়ল না। আসলে এ সব নিয়ে তখন মাথা ঘামাতাম না। ওর গান, হাসি, আমাদের কাছে নতুন কত খবর পৌঁছে দেওয়ার চেহারাটাই বড় হয়ে উঠেছিল।
রাঙাঠাকুমার কথা মনে পড়ছে। দু’টো বাড়ি পার হলেই ওঁর ছেলের বাড়ি। সেই অর্থে আত্মীয় নন, কিন্তু পাড়ার সবার রাঙাঠাকুমা তিনি। কাঁচা আম উঠলেই ওঁর ব্যস্ততা বাড়ত। রোজই এর বাড়ি-ওর বাড়ি যেতেন, কাচের বোতল হাতে নিয়ে। সেই বোতলে ওঁর ভালবাসা ভরা থাকত। যার নাম কাসুন্দি। একদিন দুটো বোতল নিয়ে এলেন। বড় পিসিমা বললেন, “এ কী! দুটো বোতল কেন?”
রাঙাঠাকুমা বললেন,“দ্বিতীয়টা ফুলের জন্য নিয়ে এলাম।”
কোথায় থাকেন ফুলমাসি? কোথায় থাকেন রাঙাঠাকুমা? দুজনের দেখা হয়েছে বহু সময়ের ব্যবধানে বার কয়েক। ফুলমাসি প্রণাম করতে গিয়েছিল রাঙাঠাকুমাকে। বুকে জড়িয়ে ধরে রাঙাঠাকুমা বললেন, “যদি বেঁচে থাকি, তবে তোর ফুল বাবুকেও কাসুন্দি খাওয়াব।”
এই সব সম্বোধনগুলো আচমকা টুপটাপ মরে গেল। রাঙাকাকা, ন’কাকা, ফুলমাসি, রাঙাঠাকুমা, সুন্দরপিসি অথবা তালুইমশাইরা উধাও হয়ে গিয়েছেন। বাবা মা চলে যাওয়ার পর এখন আমাদের সংসার স্বামী-স্ত্রী ও একটি সন্তানের। যদি মা’ও তাঁর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হয়ে থাকেন, তা’হলে মামা বা মামাতো ভাইবোনদের দেখতে পাবে না আমাদের সন্তানেরা। যে শিশুটি বড় হচ্ছে, কলকাতার হাজার স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল্যাটে, তার কাকার সংসার হয়তো হায়দরাবাদ অথবা মুম্বইতে। দেখা হওয়াটা প্রায় দুর্ঘটনার মতো। আর পিসি যদি থাকেন তা হলে মা-বাবার মৃত্যুর পরে ভাইয়ের সংসারে আসার স্বস্তি তিনি পান না। ফলে পিসতুতো ভাইবোনদের চেহারা কী রকম তাই-ই জানে না অনেক বালক-বালিকা।
মাঝে মাঝে মনে হয়, এখন দুটি মানুষের বৈবাহিক সম্পর্ক শুরু হওয়া মাত্র তারা সতর্ক থাকে যাতে সন্তান না আসে। কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যের হদিশ পেলে সন্তানকে নিয়ে আসা হয়। তারপর প্রতিটি দিন সেই সন্তানের পিছনে ব্যয় করা হয় যাবতীয় মনোযোগ। কিনে দেওয়া হয় সুযোগগুলো, যাতে সে তেইশ-চব্বিশে এমন একটি চাকরি পায়, যার শুরু হবে ষাট হাজারে। সেই চাকরির ডানায় জোর এলে সন্তান পাখি হয়ে উড়ে যাবে জেনেও এই কর্তব্য থেকে নিস্তার নেই। একজন মুরগির ব্যবসায়ী বলেছিলেন, “দিশি মুরগি বড় হতে অনেক বেশি সময় নেয়। ওজনেও মার খাই। তার চেয়ে ব্রয়লারে অনেক লাভ। কয়েক সপ্তাতেই নাদুশ-নুদুশ।”
ন’কাকা-ফুলমাসিদের সময়ে ব্রয়লার চিকেন ছিল না।
ভাবতে কী রকম বিস্ময় জাগে, এরা কেউ আমাদের পরের ছেলে বলে ভাবতেন না, আমার মামার বাড়িতে সবচেয়ে প্রবীণাকে আমরা বড়মা ডাকতাম। মা-ঠাকুমা, দিদিমার ওপরে বড়মা। এই বড়মা তাঁর ঠাকুরকে সময় দেওয়ার পর আমরা যাতে ভাল থাকি, সে দিকে নজর রাখতেন, সংসারের ভার থাকত দিদিমা বা মাসিদের ওপর। কিন্তু তাঁকে অসম্মান করার সাহস কেউ দেখাত না। আমার বড় পিসিমার এগারো বছরে বিয়ে হয়েছিল। বারোতে বিধবা হয়ে বাপের সংসারে ফিরে এসেছিলেন। আমার বাবা তখন শিশু। আমৃত্যু থেকে গিয়েছেন বাবার সঙ্গে। ভাইদের বড় করেছেন, মানুষ করার চেষ্টা করেছেন আমাকে। মা-কাকিমাদের তো বটেই, নাতবৌদেরও ভালবাসতেন খুব। তাঁর কথাই ছিল অন্দরমহলের শেষ কথা। এক ভাইয়ের নতুন বৌ এসে উদ্ধত গলায় বলেছিল, “আপনি বলার কে? আপনি তো এ বাড়িতে আশ্রিত।” বাড়িতে যেন বজ্রপাত হয়েছিল। সবাই একত্রিত হয়ে সেই বউয়ের স্বামীকে, যে কিনা বাড়ির ছেলে, বলা হল, বৌ নিয়ে আলাদা সংসার করতে। সে যেতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু মজার ব্যাপার হল, যেতে বাধা দিয়েছিল বড় পিসিমা, “ছি ছি ওরা যাবে কেন? তার চেয়ে আমাকে তোরা কাশীতে পাঠিয়ে দে।”
এই ধরনের পিসিমাও আজ হারিয়ে গিয়েছেন। মায়ার কাজল মুছে গিয়েছে আমাদের। এখন বেঁচে থাকা স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে। হঠাত্ খেয়াল হল, বাল্যকালে টম্যাটো বা চিলি সস ছিল না। ছিল কাসুন্দি। তারপর কাসুন্দি লোপ পেয়ে গেল। পরিপাটি করে বানানো ঝামেলা। কাসুন্দির স্বাদ ভুলে গিয়েছিলাম। বহু বছর পরে কাসুন্দি ফিরে এল বাক্সবন্দি হয়ে। স্বাদে খামতি হলেও কাসুন্দি তো!
ফুলমাসি, বড়পিসিমা, রাঙাঠাকুমারা তো আর নতুন চেহারায় ফিরে আসবেন না। |
মডেল: অপরাজিতা আঢ্য
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
|
|
|
|
|