হাঁড়ির খবর
মন বলে চা-ই চাই গো
চা যা ছিল, আর যা হয়েছে!
আর একটা পয়লা বৈশাখের পদধ্বনির আবহে জীবনে যা হল, হবে, যা হবার নয় তা নিয়ে হা-হুতাশের পটে এই আক্ষেপ খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে। কাপে কাপও বলাই যায়। ঝকঝকে আপিসে টি-ব্যাগ-সিঞ্চিত তরলে চুমুক দিয়ে মুখের বিকৃতি আকছার মনে বা কাজেও ছড়িয়ে পড়ে। বাইরে মহাদেবদা’য় ঠেক মারতে গেলেও তো আজকাল কফিরই আগ্রাসন। একটু ভাল চায়ের সন্ধানে অতএব ঠাঠা রোদে বড় রাস্তা অবধি হন্টন ছাড়া গতি নেই।
দুচ্ছাই! এর থেকে কফির তাৎক্ষণিক উগ্রতাই যেন ভাল। ঢাকুরিয়ার দক্ষিণাপণ বাজারের এক কোণে তাঁর চিলতে চা-ঘরে বসে ডলি রায় তবু এই কফি-আসক্তির খবরে স্তম্ভিত হবেন। এত কফি কেন খাও? শুনে রাগ হয়!
মনে মনে দীর্ঘশ্বাস পড়ে, আমি তাই তো ‘চাতক’ হলাম না, মনের মতো চা পেলাম না! এটা ঘটনা, কফি যেমন তেমন তা-ও মুখে তোলা যায়। চা ভাল না হলে জাস্ট ওয়াক থু! কলকাতাময় এখন কফিরই আধিপত্য। পাড়ায় পাড়ায় বহুজাতিক কফিওলাদের কলোনি। আমাদের নিঃশ্বাস নেওয়ার সেই সব ফুটপাথ-রোয়াক ক্রমশ প্রোমোটারির কল্যাণে বেদখল। কার্তিকের চায়ের দোকানের শোকগাথাও ঘন ঘন লেখা হচ্ছে। সুমনের গান বাজে, “তোর চায়ে মন ভরে না...এ শতক বিশ্বায়নের!” বিশ্বায়নে ক্ষতি নেই। তা বলে চায়ের নামে ওই সব গুষ্টির পিণ্ডি গিলতে হবে? বেশির ভাগ কফিশপেই চা অবধারিত টি-ব্যাগ নির্ভর। আর আইস টি নামে যেটা দেওয়া হয়, তার মধ্যে চা-ত্ব খোঁজার থেকে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়াও সহজ। চিনে রেস্তোরাঁয় ফুলের নির্যাসের জেসমিন টি, ক্যামোমিল টি বেঁচে থাকুক। কিন্তু সে কি সত্যি সত্যি চা হল? বলবন্ত সিংহের ধাবায় এক ডজন রসগোল্লার ভাঁড় উপচানো দুধেল জাফরানি চায়ের বিস্তর নামডাক। কিন্তু চা-পাতার আমেজসন্ধানী বাঙালির তাতেও মন ভরে কই? খুঁজে-খুঁজে বার করতে হবে লেকমার্কেটের রাধুবাবু, খিদিরপুরের পাঁচুবাবু বা ডেকার্স লেনের চিত্তদাকে। এখনও বাঁধা সাপ্লায়ার মারফত অসমের সতেজ সিটিসি আর দার্জিলিংয়ের কী একটা পাতার মিশেলে কলকাতার ‘মরুপরিচারণক্লান্ত’ অভাগাদের এক ফোঁটা শান্তি তাঁরা দেন বটে, কিন্তু একটা শহরের চা-চিত্র হিসেবে এটুকু খুব একটা উজ্জ্বল ছবি নয়।
ফুটের চায়ের দোকানের চোদ্দো আনাই বার বার ফোটানো চা-কাম-গরম জলের কারবারে ব্যস্ত। চায়ের সার্বিক অবক্ষয়ে এই কলকাতার বিশ্বভারানত শুষ্করুটিনপথের পথিকদের জন্য ডলির চা-ঘরটুকু ওয়েসিস। একটু বিলম্বিত ব্রেকফাস্টে দিনটা এখানে শুরু করতে হলে আপনি কাকে বাছবেন? শীতশেষে বাগানের প্রথম ফসল, মধ্যমার্চের স্নিগ্ধ ফার্স্টফ্লাশ না মন ভাল করে দেওয়া প্রাণবন্ত মাসকাটেল।
অক্টোবর-ডিসেম্বরের শরৎশস্য অটাম-ও অনেকের প্রিয়। সেই স্বাদে নাকি এক অনন্য মেধার উদ্ভাস। এ সবই চা-রসিকদের মনের আয়নার প্রতিফলন। তবু ডলির চা-ঘর শুধু চা সাজিয়ে দেয় না, আম কলকাত্তাইয়াকে চা-সচেতন করার চেষ্টাও করে। করে আসছে, আজ পঁচিশ বছর।
এই সিকি শতক সময়টা খুব কম নয়, ভেবে দেখুন। এই সময়কালেই আমাদের জীবনে মোবাইল, ইন্টারনেট, মাল্টিপ্লেক্স, শপিংমল এসেছে। ডলির চা-ঘর সময়ের স্রোতে গা ভাসায়নি। শুধু মনের জানলা খোলা রেখেছে। এ কালে আইসিসিআর-এর তে কাফেও নানা কিসিমের চা পরিবেশন করে বটে, কিন্তু ডলির পরিবেশের একটা অন্য মজা। এসি-র আরামের তোয়াক্কা করে না। দেওয়ালে চায়ের বাক্সের সাজ বা চায়ের পেটির টেবিলের শোভায় আগাপাশতলা চা-চা গন্ধ!
সদ্যপ্রয়াত গণেশ পাইন মাঝেমধ্যে আসতেন। নিঃশব্দে তাঁর প্রিয় মাসকাটেলের কাপ নিঃশেষ করে উঠে যেতেন। আবার একেলে পরমব্রত-স্বস্তিকারাও নাকি আইস টি-র খোঁজ করেন। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের গলা বাঁচিয়ে ডলির সুতীক্ষ্ণ নজরদারিতে বরফ ছাড়া ঠান্ডা চা পরিবেশন করা হয়। এবং বলতেই হয়, স্রেফ খানদানি চা নয়, আইস টি-র মাধুর্যেও চায়ের নিজস্ব মহিমা এখানে খাটো হয়নি।
ডলিদির দোকানের গোটা মেনুটা পান করলে একটা আস্ত চা-পুরাণ পড়া হয়ে যাবে। গ্রিন টি থেকে গরম চায়ের সঙ্গে তরমুজ-আনারসযোগে বিশেষ পানীয় মজুত। নতুন সৃষ্টি চা-টোম্যাটো জুসের মিশেলে টি-টোম্যাটো আর পিঙ্ক শ্যাম্পেন। এই ‘শ্যাম্পেন’ মদিরাবিহীন। দুর্লভ চা-কুঁড়ির (হোয়াইট টি) সঙ্গে ফার্স্টফ্লাশ ও কিছু গোপন তুকতাকে সৃষ্টি এটি। দুর্লভ বলে ওই সব চা-কুঁড়ির ‘সাদা’ চা বা কুঁড়ির ডগার ‘রুপোলি’ চা রীতিমতো মহার্ঘ।
সুগন্ধী লিকারের সঙ্গে এক খণ্ড আভেন-তপ্ত ঘরোয়া অরেঞ্জ বা চকোলেট কেক খাবেন? না, গরমে ঠান্ডা চায়ে চুমুকের ফাঁকে একটা জমকালো হ্যাম স্যান্ডউইচ মারবেন? চায়ের সঙ্গে টা-এর ব্যবস্থাও এ তল্লাটে মন্দ নয়!
চা-ময় জীবন ডলির। রোজ বিকেলে দোকানে আসেন। এক কোণে বসে ইতিহাসের কোনও পোড়খাওয়া নারীর ভঙ্গিতে খুঁটিয়ে দেখেন আপ্যায়নের বন্দোবস্ত। তাঁর আফশোস, এখনও চা করা শেখায় বাঙালির খামতি রয়ে গিয়েছে। গিফ্ট-প্যাকে বা বাড়ির জন্য পছন্দের চা-পাতা কেউ নিয়ে গেলে ডলি পরামর্শ দেন, এক কাপের জন্য কিন্তু সব-সময়ে এক চা-চামচ পাতাই বরাদ্দ। আর চায়ের কেটলির জন্য বাড়তি এক চামচ রাখার দরকার নেই।
যাঁরা একটু দূরে থাকেন, ঢাকুরিয়ার দিকটায় ঘন-ঘন আসা হয় না, এক কাপ মাসকাটেলের জন্য তাঁদের অনেকেরই দীর্ঘশ্বাস ঘনিয়ে ওঠে। যেমন-তেমন চা খাওয়া হয়ে যায় প্রায়ই, আর বিরহটা গাঢ় হয়।
চায়ের দোকানের ট্রানজিস্টরে বাজে, “এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই...”

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.