|
|
|
|
|
|
ব্যাগ গুছিয়ে...
|
ডলফিনের ডেরায়
কোনওটা জল থেকে বেশ খানিকটা লাফিয়ে
উঠছে।
কোনওটা বা
অন্যকে ধাওয়া করছে।
লিখছেন দেবদূত ঘোষঠাকুর |
|
খাঁড়ি ছেড়ে ক্রুজটা প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে এগিয়ে যেতেই আমাদের ক্রুজের ক্যাপ্টেন হ্যারিস সবাইকে নীচের ডেকে গিয়ে দাঁড়াতে বললেন। ক্যাপ্টেনের ঘোষণা, “কোনও বাইনোকুলারের দরকার নেই। আমার কথা শুনে জলের দিকে নজর রাখুন। দেখা মিলবেই।”
আমরা যাচ্ছিলাম নিউ সাউথ ওয়েলস-এর পর্যটন কেন্দ্র সেন্ট স্টিফেন্স-এর সমুদ্রে, ডলফিন দেখতে। সিডনি থেকে ২৯৭ কিলোমিটার দূরের এই পর্যটনকেন্দ্রটি সারা বছরই সামুদ্রিক প্রাণী-বিশেষজ্ঞদের ভিড়ে ঠাসা থাকে। সমুদ্রে জাল ফেলতে হয় না, ছিপ ফেলেই ধরা যায় হরেক কিসিমের মাছ। মিনিট পাঁচ-দশ অপেক্ষা করলেই দেখা যাবে মাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বড়শির সুতো। একটু কায়দা করে টান মারতে পারলেই হল! বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করলে মিলতে পারে পেল্লাই সাইজের চিংড়ি কিংবা কাঁকড়া।
|
|
খাঁড়ি যেখানে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে সেই এলাকা আবার ডলফিনের ঘরবাড়ি। আমরা যে সংস্থার ক্রুজে চেপে যাচ্ছিলাম তার অন্যতম কর্তা জন লংওয়ার্থ বললেন, “ডলফিন দেখতে এখানে দেশ-বিদেশের পশুপ্রেমীরা সারা বছর ভিড় করেন। সারা বছরই ওদের দেখা যায়। প্রতি বছর দলে নতুন নতুন সদস্য থাকে। বছরে এমন একটা দিনও নেই যে দিন পর্যটকেরা গিয়ে ডলফিন না দেখে ফিরেছেন। তোমাদের ভাগ্য ভাল থাকলে বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানকেও দেখতে পাবে।”
জন আর কাপ্টেন হ্যারিস সারা বছর প্রতি দিন দু’বার করে ক্রুজ নিয়ে সমুদ্র আর খাঁড়ির সংযোগস্থলে যান। কোথায় ক’টা ডলফিন আছে তা তাঁর মুখস্থ। কোন ডলফিনের জোড়া কোনটা। বাচ্চাটা কার কার মিলনের ফল তা-ও হলফ করে বলে দিতে পারেন হ্যারিস। বললেন, “এই অঞ্চলটায় অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি ডলফিন এই মুহূর্তে রয়েছে। পাঁচটা থেকে ছ’টা মিলে এক একটা ঝাঁক। সকাল থেকে রাত ওরা এখানকার জলে খেলে বেড়ায়। দেখবেন আমাদের ক্রুজের চারপাশে কেমন চক্কর কাটছে।”
সমুদ্রে এ দিক ও দিক আরও চারটি ক্রুজ। ওরাও ডলফিন দেখতে বেরিয়েছে। যে ক্রুজ আগে ডলফিন দেখবে তার ক্যাপ্টেন সঙ্গে সঙ্গে অন্য ক্রুজের ক্যাপ্টেনদের তা জানিয়ে দেবেন। বাকি ক্রুজগুলি সেই দিকেই এগিয়ে যাবে। খাঁড়ি বেয়ে তত ক্ষণে আমরা চলে এসেছি অনেকটা। একটা সমুদ্রতট দেখা যাচ্ছে সামনেই। জলের ভিতর থেকে উঁকি মারছিল পাথর। আর সেই পাথরের দিকে তাকিয়ে হ্যারিস চেঁচিয়ে উঠলেন, “আমাদের ডান দিকের পাথরগুলির দিকে লক্ষ করুন।”
এ বার সবার নজর গেল সে দিকে। হ্যারিস ক্রুজটা আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যেতেই দেখি একটা-দুটো নয়, একসঙ্গে ছ’টা ডলফিন। তার মধ্যে একটা আকারে কিছুটা ছোট। পাথরের নীচে চলে যাচ্ছে, একটু পরেই ভুস করে ভেসে উঠছে। আবার ডুব সাঁতার দিয়ে চলে যাচ্ছে পাথরের নীচে। হ্যারিস বললেন, “ওরা গোটা একটা পরিবার খাবার খুঁজছে। এর মধ্যে যেটা আকারে ছোট সেটা গত বছরের শাবক।” ক্রুজের অভিমুখ এ বার অন্য দিকে ঘোরালেন হ্যারিস। তিনি তত ক্ষণে খবর দিয়ে দিয়েছেন অন্য ক্রুজের ক্যাপ্টেনদের। সেগুলিও তত ক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের
ক্রুজের আশপাশে।
|
|
হ্যারিস ক্রুজটিকে ফের নিয়ে এলেন খাঁড়ির অনেকটা ভিতরে। আর কেন এলেন তা বুঝতে পারলাম একটু পরেই। হ্যারিসের নির্দেশ, “ন’টা বাজলে ঘড়ির ছোট কাঁটা যেখানে থাকে সে দিকে ক্যামেরা তাক করে থাকুন।” আমরা ক্যামেরা তাক করে বসে এক, দুই, তিন, চার... গুনে চলেছি। পাঁচের আগেই ক্যামেরায় ধরা পড়ল একটা ডলফিন। জল থেকে লাফ দিয়েছে। হাত কেঁপে গেল। কিন্তু তাতে হতাশ হতে দিল না পিছনে আসা আরও তিনটি। তত ক্ষণে আমার চার দিকে ক্লিক ক্লিক করে ক্যামেরার শাটার পড়তে শুরু করেছে। যেন আমাদের খুশি করতে আশাপাশে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল ডলফিনগুলি। তার পরে ডুব সাঁতার দিয়ে দূরে চলে গেল। প্রায় আধ ঘণ্টা হ্যারিস ক্রুজ নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন ডলফিনের বাড়ির চার দিকে। আর আমরা এর মধ্যেই দেখলাম ডলফিনের নানা রকম কসরত। কোনওটা জল থেকে বেশ খানিকটা লাফিয়ে উঠছে। কোনওটা বা অন্য ডলফিনের পিছনে ধাওয়া করছে। তখন ডুব দিয়ে আবার সেই জায়গাতেই উঠে আসছে। ক্যামেরার ফ্রেমে সব সময়ে ধরে রাখতে সমস্যা হচ্ছিল। গত বছর ব্রিসবেন থেকে ট্যাঙ্গালুমা যাওয়ার পথে আমাদের ক্রুজের পাশে পাশে ডলফিনের একটা ঝাঁককে দেখেছিলাম। ট্যাঙ্গালুমা দ্বীপে সন্ধ্যার মুখে ডলফিনদের মাছ খাওয়ানোর সময়ে পর্যটকদের ভিড় করে থাকতে দেখেছি। অনেকটা পোষা ডলফিনদের মতো। সেই ডলফিন দেখার মধ্যে কিন্তু কোনও রোমাঞ্চ নেই। সেই তুলনায় সেন্ট স্টিফেন্সের সমুদ্রে ডলফিনের অবাধ বিচরণ পর্যটকদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
আমাদের ক্রুজে ছিলেন সিডনির পিটার ফ্লয়েড। পিটার প্রাণীবিজ্ঞানের অধ্যাপক। দুই নাতি-নাতনিকে নিয়ে এসেছেন ডলফিন দেখাতে। পিটার বললেন, “ডলফিন সম্পর্কে কারও উৎসাহ আছে জানলেই আমি তাদের এখানে নিয়ে আসি। আমি নিজেও ডলফিন-ভক্ত।” প্রশান্ত মহাসাগরের
এই জায়গাটায় কেন ডলফিনেরা ঘাঁটি গেড়েছে তা
নিয়ে পিটারের মন্তব্য, “এখানে মাছের কোনও ঘাটতি
নেই। যে হেতু প্রশান্ত মহাসাগরের এই জায়গাটায় তিমি মাছেরা বছরে দু’বার পারাপার করে তাই এখানে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। ডলফিনদের তাই এখানে কোনও শত্রু নেই। ওদের কাছে এটা স্বর্গরাজ্য।” |
|
শুধু ডলফিন দেখার জন্য নয়, সপ্তাহশেষে দিনদুয়েক কাটানোর জন্যও সিডনি, ক্যানবেরার বাসিন্দারা বেছে নেন সেন্ট স্টিফেন্সকে। আমরা যে হোটেলটায় ছিলাম তার এক দিকে খোলা সমুদ্র। অন্য দিকে খাড়া পাহাড়। হোটেল মানে কোনও বহুতল নয়। দোতলা বেশ কয়েকটি বাড়ি। তিনটি বাড়ি টিলার উপরে। তিনটি সমুদ্রের ধার ঘেঁষে। প্রত্যেকটিতে আটটি করে ঘর। আমার ভাগ্যে পড়েছিল সমুদ্রের ধার-ঘেঁষা বাড়ির দোতলার একটি ঘর। ঘরের বিছানায় শুয়েই সূর্য ওঠার ছবি তোলা যায়। আবার দরজা খুলে বারান্দায় এলে পাহাড়ের উপরে গাছে নজরে পড়ে নীল, লাল বেগুনিতে রাঙানো লরাকিটদের (এক ধরনের টিয়াপাখি)। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সমুদ্রের ধারে এলেই আবার অন্য দৃশ্য। পাথরের উপরে সার দিয়ে বসে হলুদ ঝুঁটির কাকাতুয়ারা। পাথরের খাঁজে জন্মানো ঘাসের বীজগুলি খুঁটে খুঁটে বের করছিল তারা। ওটাই ওদের ব্রেকফাস্ট।
মায়াবী সেন্ট স্টিফেন্সে বেড়াতে যাওয়ার আদর্শ সময় কোনটা? প্রকৃতিপ্রেমী হোটেলের কর্মী জেসি বললেন, “অবশ্যই ফেব্রুয়ারি, মার্চ। বর্ষার সময়ে কাদামাটি এসে সমুদ্রের নীল জলকে অনেকটা ঘোলা করে দেয়। আবার জোয়ারে সেই ঘোলাটে জল চলে যায় দূরে। জলের রঙের সঙ্গে আকাশের রংও ঘন ঘন পাল্টে যায়। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলে আকাশে দেখা যায় রামধনু। তার প্রতিফলন পড়ে সমুদ্রের জলে।”
তবে বন্যপ্রাণীপ্রেমী জনের কাছে সেন্ট স্টিফেন্সে ছুটি কাটানোর আদর্শ সময় জুন-জুলাই আর অক্টোবর-নভেম্বর। কেন? জনের ব্যাখ্যা, “আমরা যেখানে ডলফিন দেখতে গেলাম তার থেকে একটু দূরে গিয়ে আমরা ক্রুজের ডেকে বসে থাকি। জুন-জুলাই মাসে ওই পথ দিয়ে তিমি মাছেরা আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। দক্ষিণ মেরু অঞ্চল থেকে ওরা চলে যায় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের অপেক্ষাকৃত গরম এলাকায়। সেখানেই ওদের প্রজনন হয়। আর অক্টোবর-নভেম্বরে মাসে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে পুরো দলটা ফিরে যায় দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে। এই পথ দিয়েই। প্রতি বছর এটা ঘটে। আর এটা দেখার জন্য ভাগ্যের দরকার নেই। ডলফিনের মতো তিমিরাও এখানে নিরাশ করে না পর্যটক এবং প্রাণীবিজ্ঞানীদের।”
|
ডলফিনের ছবি: জন লংওয়ার্থ-এর সৌজন্যে। |
|
|
|
|
|