মনোরঞ্জন...
চার অধ্যায়
সাল ১৯৯৪ ।
পরিচালক মনমোহন দেশাই নিজের বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনার ঠিক দু’বছর আগে, অভিনেত্রী নন্দার সঙ্গে মনমোহন দেশাইয়ের বাগ্‌দান হয়েছিল। সেই শোক নন্দা কোনও দিন ভুলতে পারেননি।
তত দিন অভিনয় করা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। লোকজনের আড়ালে পুরোপুরি ভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন।
এর পর নন্দাকে প্রকাশ্যে দেখা যায় ষোলো বছর পর। মরাঠি ছবি ‘নটরং’য়ের স্ক্রিনিংয়ে। সেদিন তাঁর পাশে ছিলেন তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের বন্ধু অভিনেত্রী
ওয়াহিদা রহমান। মুম্বইয়ের পালি হিলের কেতনাভ থিয়েটারে নন্দা ছবিটি দেখতে এসেছিলেন একমাত্র শর্তে কোনও সংবাদ মাধ্যম বা কোনও আলোকচিত্রী যেন উপস্থিত না থাকে।
শোনা যায়, এরপর নন্দাকে দেখা গিয়েছিল ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। রঙিন ‘হামদোনো’ ছবির প্রিমিয়ারে। দেব সাবের সঙ্গে তিনি ‘হাম দোনো’ আর ‘তিন দেবিয়াঁ’র মতো হিট ছবি করেছিলেন। তাই স্মৃতির গভীরে ডুব দিয়েই হয়তো দেব সাবের অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারেননি সেদিন। এসেছিলেন ছবির প্রিমিয়ারে।
তবে যে নন্দা আর শশী কপূরের ‘ইয়ে সামা’র চিত্রায়ণ দেখে আজও বহু গুণগ্রাহী মুগ্ধ, তাঁদের অনেকেই নন্দাকে চিনতে পারেননি ‘নট রং’য়ের স্ক্রিনিংয়ে। ওদিন উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা অতুল কুলকার্নি। নন্দার বয়স তখন প্রায় সত্তর ছুঁই ছুঁই। আগেকার সেই ছিপছিপে চেহারাটা আর নেই। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে অনেক ভারী হয়ে গিয়েছেন। তবে গলার আওয়াজটা সেই এক রকম। “আমি ওয়াহিদা রহমানের সঙ্গে দুটো ছবি করেছি ‘রং দে বসন্তি’ আর ‘দিল্লি ৬’। সেই সূত্রেই আমাদের ভাল পরিচয়। ‘নটরং’ ছবিটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। আমি জানতাম যে নন্দাজি আর ওয়াহিদাজি খুব বন্ধু। তাই ওয়াহিদাজিকে অনুরোধ করেছিলাম যদি নন্দাজিকে নিয়ে ছবিটির প্রাইভেট স্ক্রিনিং-এ আসেন,” বললেন ‘নটরং’য়ের অভিনেতা অতুল।
মরাঠি ছবি। তবে দুই অভিনেত্রী সেটা দেখে খুব খুশি। “আজ মনে পড়ছে না সে রাতেই নন্দাজি কী পরে এসেছিলেন। তবে এটুকু মনে আছে যে ছবি দেখার পরে আমার সঙ্গে মারাঠিতেই কথা বলেছিলেন। বয়স বেড়ে গিয়েছিল ঠিকই, তবে নন্দাজির মতো অভিনেত্রী জানেন কী ভাবে গ্রেসফুলি বয়স বাড়তে হয়। সে দিন অনুষ্ঠানে হেলেনজিও এসেছিলেন,” বললেন অতুল।
বলিউডের পুরোনো আমলের অভিনেত্রীদের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন যে ওয়াহিদা, নন্দা আর আশা পারেখ অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার পরেও তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব অটুট ছিল। মাঝে মাঝেই দেখা হয় ওঁদের। ছোটখাটো পার্টিও হয় নিজেদের বাড়িতে। কেউ খেলতে ভালবাসেন তাস, কেউ বা মাঝেমধ্যে ধরেন তুলিও।
এখনকার ছবি দেখেন ওঁরা? “অনেকেরই ভাবেন, এঁরা আজকালকার দিনের ছবির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। কিন্তু ধারণাটা একেবারেই ভুল,” বলছিলেন অতুল, “ওয়াহিদাজির সঙ্গে অভিনয় করার সময় অনেক গল্প হয়েছিল। তখন আশ্চর্য হয়েছি শুনে যে উনি আমার প্রত্যেকটি ছবি দেখেছেন! ‘দিল্লি ৬’-এর সেটে কত গল্প হত। ‘গাইড’ ছবির গল্প। তার পর ‘সিআইডি’। শেষ দেখা হয়েছিল অমিতাভ বচ্চনের জন্মদিনের পার্টিতে,” অতুল বলেন।
তবে এটা ঠিক যে মিডিয়ার থেকে দূরেই থাকতে পছন্দ করেন এঁরা প্রত্যেকেই। বড় বড় ফিল্মি পার্টিতে যাওয়ার ঝক্কি নেওয়ার মধ্যে নেই। এই ধরুন অভিনেত্রী সাধনার কথা। আজও ‘ওয়াক্ত’, ‘অসলি নকলি’, ‘ওহ কওন থি’ আর ‘মেরা সায়া’র কথা বলতে গেলে তাঁর নাম সকলের মনে ঘুরে ঘুরে ফেরে। কপালে অড্রে হেপবার্নের স্টাইলে চুল ফেলাটা বিখ্যাত করেছিলেন সাধনা, ‘ফ্রিঞ্জকাট’ করে। বহু কাল থেকে মুম্বইয়ের ফিল্মি জগতে তাঁকে দেখা যায়নি। স্বামী পরিচালক আর কে নায়ারের মৃত্যু হয় ১৯৯৫ সালে। ছবি করা অনেক দিন আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের অফিসের লোকজনকে সাড়ে তিন মাসের নোটিশ দিয়েছিলেন। এর মধ্যেই নিজের প্রোডাকশন হাউসের সব কাজ গুটিয়ে ফেলেন।
এখন একেবারেই নির্ভেজাল রিটায়ার্ড জীবন সাধনার। সকালে দু’ঘণ্টা বাগান করা। কোনও কোনও দিন ক্লাবে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তাস খেলা। রাতে অল্পবিস্তর টিভি দেখা। ব্যস। সাধনা নিঃসন্তান। তবে এ নিয়ে আজ আর কোনও দুঃখ নেই তাঁর। মাতৃত্বের স্নেহ উজাড় করে দিতে জানেন তিনি। বাড়িতে থাকে ফুটফুটে একটি মেয়ে। বছর দশ-বারো বয়স। নাম রিয়া। সাধনার সেক্রেটারির কন্যে। রিয়ার পড়াশুনোর সব খরচখরচা, এমনকী তাঁর বিয়েরও দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিয়েছেন তিনি। এভাবেই আর পাঁচজনের মতোই অবসর জীবন নিতান্তই নিপাট, স্বস্তি আর শান্তি নিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দিতে চান সাধনা।
তবে এই শান্তির জীবনে হঠাত্‌ এলোমেলো হয়ে যায় ২০১০ সালে। আশা ভোঁসলের সঙ্গে একটি অবাঞ্ছিত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন সাধনা। বিতর্কটি ছিল সান্টাক্রুজের একটি বাড়িকে নিয়ে। ‘সঙ্গীত’ নামের এই দোতলা বাড়িটির মালকিন ছিলেন আশা ভোঁসলে। সেই বাড়িটির এক তলায় তিন হাজার স্কোয়্যার ফুটের একটি ফ্ল্যাটে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে থাকেন সাধনা। বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের ঝগড়া গড়ায় পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত। সাধনার আইনজীবী শ্যাম কেশওয়ানি জানান, “এই বাড়িটির প্রথম মালকিন ছিলেন আশা ভোঁসলের স্বামী। তিনি মারা যাওয়ার আগে বাড়িটি দু’জন আশা ভোঁসলের নামে লিখে দিয়ে যান।” ‘দুজন’ আশা ভোঁসলে? স্পষ্ট করেন শ্যাম, “ভদ্রলোকের দু’টি বিয়ে ছিল। আর ঘটনাচক্রে দুই স্ত্রীর নামই আশা। এই আশা ভোঁসলে ২ (লতা মঙ্গেশকরের বোন) বাড়িটি ভাড়াটিয়া সমেত বিক্রি করে দিয়েছেন অন্য কাউকে। এই নতুন মালিক আদালতকে জানিয়েছেন যে সাধনা যেন এই বাড়িটি খালি করে দেন। এক সপ্তাহ আগে আদালত এ বিষয়ে একটি সমন পাঠিয়েছে। তবে মামলা এখন অনেক দূর গড়াবে।”
শ্যামের সঙ্গে সাধনার প্রায়ই দেখা হয়। “বাড়িতেই থাকেন তিনি। মুম্বইয়ের বাইরে বেড়াতে যাওয়ারও বিশেষ শখ দেখিনি কখনও। মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখেন। রান্নাবান্না পছন্দ করেন। কাবাবটা বেশ ভাল বানান,” বলেন শ্যাম।
এই প্রবীণাদের ভিড়ে বৈজয়ন্তীমালা বালি অবশ্য আজও সক্রিয়। থাকেন চেন্নাইয়ে। ড. চমনলাল বালির সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর সিনেমা করা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। তবে ভরতনাট্যমটা ছেড়ে দিতে পারেননি। আজও দেশে বিদেশে অনুষ্ঠান করেন। ছেলে সুচীন্দ্র বালি কিছু তামিল ছবিতে অভিনয় করেছেন। বলেন, “বাবা আর মা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলেন যে বিয়ের পর মা আর অভিনয় করবেন না। আমি কোনও দিন মা’কে সেটেই যেতে দেখিনি।”
তবে অভিনয় জীবনের গল্প করতে আজও ভালবাসেন বৈজয়ন্তী। “মা’র কাছেই শুনেছি তপন সিংহ’র ‘হাটেবাজারে’ করার অভিজ্ঞতার কথা। বলতেন কী ভাবে একটা বাংলা গান ‘শ্যাম তোর তরে তমাল তলে বসে থাকি’ গেয়েছিলেন ছবিতে। তার পর ‘মধুমতী’ থেকে বিমল রায়ের গল্প। সিনেমা ছেড়ে দিলেও মা নাচ নিয়ে আজও অসম্ভব আবেগপ্রবণ। ডিসেম্বর মাসে চেন্নাইতে প্রচুর অনুষ্ঠান হয়। মা সে সব নিয়ে এখনও খুব ব্যস্ত থাকেন। গত মাসেও দু’টো অনুষ্ঠান করেছেন। একটি দিল্লিতে, অন্যটি চেন্নাইতে। গরম কালে মা অবশ্য নাচের অনুষ্ঠান করেন না। তবে কোনও কিছুতেই বেশি রিজিড নন। মাঝে মধ্যে ঘুরেও বেড়ান। এক সময় রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন। এখন নেই। তবে আজও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সম্পর্কে বেশ সচেতন,” ছেলে বলেন।
কাজের ফাঁকে সব চেয়ে বেশি পছন্দ করেন গল্ফ খেলতে। “বাবা আমাকে আর মা’কে গল্ফ খেলতে খুব উত্‌সাহ দিতেন। এই বয়েসেও মা’কে গল্ফ খেলতে দেখি। বেশ কয়েকটা কাপও জিতেছেন তিনি।”
আর সিনেমা? “হ্যাঁ, নিজের ছবি দেখেন। আর আমির খানের ছবি খুব পছন্দ করেন,” বলেন বৈজয়ন্তী-পুত্র।
কথায় বলে লাইমলাইটের হাতছানি এড়ানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। কী করে পারেন এঁরা অভিনয় জগত্‌ থেকে নিজেদের একেবারে সরিয়ে নিতে?
অতুল বলেন, “ওয়াহিদাজি চাইলে কত ছবি করতে পারেন! তবে উনি ঠিক সেই কাজটাই বেছে নেন যেটা ওঁর মনে ধরে।”
আর বৈজয়ন্তীমালা? “আমার জন্মের পরেও দেখেছি মা’র কাছে কত বড় বড় অফার এসেছে। তামিল ছবি, হিন্দি ছবি। অনেকে এও বলেছেন যে মা আর আমি যেন একসঙ্গে ছবি করি,” বলেন সুচীন্দ্র। আরও জানান, ‘‘তবে মা’র কথা হল, কেরিয়ারের শীর্ষে থেকে উনি সিনেমা ছেড়ে দিয়েছেন। কোনও অনুশোচনা নেই তাঁর। যার মোহ এক বার ছেড়ে দিয়েছেন, সেখানে আবার ফিরে যাওয়া কেন?”
সাধনার অবশ্য অভিনয়ের কোনও ঝোঁকই নেই। মনে পড়ে ‘হাম দোনো’র সেই গান? যেখানে বার বার দেব আনন্দ নায়িকা সাধনাকে বলছেন,“আভি না যাও ছোড় কে/ কি দিল আভি ভারা নাহি”? আর তার উত্তরে তিনি বলছেন, “বস্‌ আব না মুঝকো টোক না/না বাড়কে রাহ্‌ রোখ না/আগর ম্যয় রুখ গ্যায়ি আভি/ তো যা না পাউঙ্গি কভি।” যদি থেমে যাই, কোনও দিনও আর যাওয়া হবে না!
হয়তো সাধনা ও তাঁর বন্ধুদের জীবনে এটাই এখনকার সত্যি। ভালবাসার পিছুডাক আসবেই, গুণগ্রাহীদের কাতরতা থাকবেই ... “আভি না যাও ছোড়কে কি দিল আভি ভারা নেহি....।”
কিন্তু সেই সজল ডাকে সাড়া না দেওয়ার মধ্যেও হয়তো বা থাকে এক অনাবিল প্রশান্তি। বেঁচে থাকার, ভাল লাগার...

পর্দায় শেষ দেখা যায়
ওয়াহিদা রহমান দিল্লি ৬ (২০০৯) • সাধনা উলফত্ কি নয়ি মঞ্জিলে (দেরিতে মুক্তিপ্রাপ্ত, ১৯৯৪)
নন্দা প্রেমরোগ (১৯৮৩) • বৈজয়ন্তীমালা বালি প্রিন্স (১৯৬৯)
হিট লিস্ট
নন্দা
• ভাইয়া মেরে (ছোটি বহেন)
• ঈশ্বর তেরো নাম (হাম দোনো)
• নানা কারতে হুয়ে পেয়ার (যব যব ফুল খিলে)
• লিখা হ্যায় তেরি আখোঁ মেঁ (তিন দেবিয়াঁ)
• জানে চমন শোলা বদন (গুমনাম)
সাধনা
• ও সজনা বরখা বাহার আয়া (পরখ)
• আভি না যাও ছোড়কে (হাম দোনো)
• নয়না বরসে রিমঝিম রিমঝিম (উয়ো কৌন থি)
• তেরে মেরা প্যায়ার অমর (আসলি নকলি)
• নয়নো মে বদরা ছায়ি (মেরা সায়া)
বৈজয়ন্তীমালা
• বোল রে কাঠপুতলি মেরি (কাঠপুতলি)
• আজা রে পরদেশি (মধুমতী)
• ম্যয় কেয়া করু রাম (সঙ্গম)
• রুলা কে গয়া সাপনা (জুয়েল থিফ)
• হোঁটো পে অ্যায়সি বাত (জুয়েল থিফ)
ওয়াহিদা রহমান
• কঁহি পে নিগাহেঁ (সিআইডি)
• জানে কেয়া তুনে কহি (পিয়াসা)
• কঁহি দীপ জ্বালে (বিশ সাল বাদ)
• আজ ফির জিনে কি তমান্না হ্যায় (গাইড)
• রঙ্গিলা রে (প্রেম পূজারি)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.