দলের নেতারা বলেছিলেন, মন দিয়ে তৃণমূল করো, তা হলে একটা চাকরি হয়ে যাবে। সেই লোভে ছেলেটা গেল। এখন ওনারাই বলছেন, ও দলের কেউ নয়!
হাওড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতাল-লাগোয়া আবাসনের দু’কামরার ঘরে বসে ইরাবতীদেবী যখন কথাগুলো বলছিলেন, বাড়িতে তখন পিন পড়লেও আওয়াজ হবে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ছেলের গ্রেফতারের খবর পাওয়ার পর থেকে চোখের পাতা এক করতে পারেননি। সারা রাত দরজার দিকে চেয়ে বসেছিলেন। ছেলে ফেরেনি। কবে ফিরবে, জানেন না মা।
কেউ জানেন না, প্রেসিডেন্সিতে হামলায় অভিযুক্ত শুভজিৎ বর্মনকে আদালত কবে মুক্তি দেবে। শুক্রবার শুভজিৎ-সহ চার জনকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বিচারক ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত জেল হেফাজতে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজের কলা বিভাগের ছাত্রটির এখন জেলের খুপরিতে দিন কাটবে। মন মানছে না মায়ের। শত হোক, তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট তো!
একই অভিযোগে শুভজিতের সঙ্গেই ধরা পড়েছেন জয়ন্ত হাওলাদার। দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘুটিয়ারি শরিফের ডিসকো বাজারের কাছে শক্তিপল্লিতে জয়ন্তদের বাড়ি। পড়েন সুরেন্দ্রনাথ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষেই। জয়ন্তর বাবা রমেশ হাওলাদার কাঠের মিস্ত্রি। বাড়িতে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। মামলা লড়ার টাকা আসবে কোথা থেকে, ভেবে পাচ্ছেন না স্থানীয় তৃণমূল নেতা মনোজ ব্যাপারী। তা-ও আশ্বাস দিয়েছেন, গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে মামলার খরচ দেওয়ার চেষ্টা করবে। তাঁর কথায়, “সব রকম ভাবে চেষ্টা করব। আমাদের গ্রামের ছেলে তো!” |
ধৃত শুভজিৎ বর্মনের বাবা ও মা। —নিজস্ব চিত্র |
কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ছাত্র জয়ন্ত সে দিন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন কেন?
বৃহস্পতিবার রাতে টিভি দেখে পরিজনেরা জানতে পারেন জয়ন্তর গ্রেফতারের খবর। তাঁরাও একই রকম অবাক! পরিবারের সকলে অবশ্য তৃণমূলেরই সমর্থক। কিন্তু জয়ন্তর বাবার কথায়, “আমার ছেলে কোনও ভাঙচুরের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে বলে আমি মনে করি না।” বৌদি রিঙ্কুর দৃঢ় ধারণা, পুলিশই ফাঁসিয়েছে জয়ন্তকে। প্রতিবেশীদের বক্তব্য, এলাকায় তৃণমূল সমর্থক বলেই পরিচিত হলেও জয়ন্ত খুব বেশি মিছিল-মিটিংয়ে থাকতেন না। স্থানীয় তৃণমূল নেতারাও জানাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচয় ছিল জয়ন্তর। তবে সক্রিয় ভাবে এলাকায় রাজনীতি করতেন না ওই যুবক। “কলেজে কী করত, তা অবশ্য বলতে পারব না।” ক্যানিংয়ে জয়ন্তর এক সহপাঠী যদিও বললেন, “কলেজে তৃণমূলের নানা কর্মসূচিতেই জয়ন্ত থাকত। ওই দিন ছিল কি না, বলতে পারব না। আমি সে দিন যাইনি।”
শুভজিতের পরিবারের কাছে কিন্তু বিষয়টা জলের মতো পরিষ্কার। ঘটনার দিন রাতে বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে বাড়ি ফিরে মায়ের প্রশ্নের উত্তরে শুভজিৎ নিজেই বলেছিলেন, দলের নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজে আন্দোলন করতে গিয়েছিলেন। তখনই জামা ছিঁড়ে গিয়েছে। ইরাবতীদেবীর কথায়, “সব শুনে আমি খুব বকেছিলাম। ও-ও খুব অনুতপ্ত হয়েছিল। পরে আমার কাছে স্বীকার করেছিল,
চাকরির লোভে গিয়েছিলাম। যাওয়াটা ঠিক হয়নি।”
বর্মন দম্পতির আক্ষেপ, শুভজিৎ ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্কুলে বরাবর প্রথম হতেন। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই রাজনীতি নিয়ে মেতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়েন। প্রথম বর্ষে খারাপ রেজাল্ট করায় অনার্স বাদ যায়। পরিবারের বক্তব্য, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতারা শুভজিৎকে বুঝিয়েছিলেন, মন দিয়ে দল করলে চাকরি হবে। কিন্তু এখন দলের নেতারাই বলছেন ও দলের কেউ নয়। মায়ের কথায়, “অনেক করে বারণ করেছিলাম। শুনল না। এখন...!”
শুভজিতের বাবা উদয় বর্মন স্টেট জেনারেল হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার। শান্ত গলায় বললেন, “ও অন্যায় করেছে। শাস্তি হয়েছে। আইন আইনের পথেই চলবে।” ছেলের জামিনের ব্যবস্থা করতে, বা কোর্ট লকআপে গিয়ে ছেলের সঙ্গে দেখা করতেও চান না উদয়বাবু।
|
(সহ-প্রতিবেদন সামসুল হুদা) |