ধুলোমাখা ফাটা পায়ের গোছে জড়ানো ঘুঙুর। ঘামে জবজবে গেঞ্জি লেপ্টে রয়েছে গায়ে। গনগনে চোখ, স্বরে অভিমান, কথায় ক্ষোভ। চৈত্র মাস জুড়ে নদিয়ার এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই শিল্পীরাই গান গাজনের সন্ন্যাসী তথা “বালার” গান। যার আনুষ্ঠানিক নাম বোলান। আর তাতেই এখন রাজনৈতিক কথাবার্তা সরাসরি ঢুকে পড়ছে।
সময়টা ২০১১। সে বার চৈত্রে গাজুনে বালার বোলানে ছিল কেবলই পরিবর্তনের বোল। গান বাঁধা হয়েছিল
“শুনুন শুনুন বঙ্গবাসী, শুনুন দিয়া মন
ওগো এই আসরে পেটের কথা করিব বর্ণন
ভোট, ভোট, ভোট এল বঙ্গে
ওগো পরিবর্তনের হাওয়া নিয়ে এল সঙ্গে
বঙ্গবাসীর মুখে মুখে একটিই কথা তাই
খুনি বাম সরকারের আমরা পরিবর্তন চাই
কর্মনাশা মিথ্যাচারী
শূন্য কোষাগার
ভাঁওতাবাজী সরকারের আর নেই দরকার
আমরা সবে লোকশিল্পী গাই বুলান গান
ওগো সব আসরেই গেয়ে বেড়াই পরিবর্তনের গান।”
এ রাজ্যের পালাবদলের ঠিক আগে এই গান অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল। সাদা ধুতি, গেঞ্জি পরে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে ঢোল কাঁসি বাজিয়ে সে বার কৃষ্ণগঞ্জ, পাবাকালি, শিবনিবাস বা চূর্ণী পার হয়ে কৃষ্ণপুর দাপিয়ে বেরিয়েছিলেন নিমাই ঘোষ, প্রাণদা ঘোষ, স্বপন ঘোষের মতো তিন পুরুষের বোলান গায়কেরা।
এ বার ২০১৩-র চৈত্রে সেই সব মুখই আবার গাইছেন,
“ওগো রাজনীতিতে দাদাগিরি সব আমলেই ছিল
এই আমলেও দাদাগিরি কমবেশি যে হল
বাম আমলে মজিদ মাস্টার, তপন-সুকুর হয়েছিল
তাই তো বলি শুনুন দিয়া মন
ওগো এই দাদারাই বঙ্গের অশান্তির কারণ।”
নদিয়ার পূর্ব দিকে কৃষ্ণগঞ্জ, হাঁসখালি এবং উত্তর দিকে কালীনগর, নাকাশিপাড়া, তেহট্ট প্রভৃতি এলাকায় নিম্নবিত্ত কৃষিজীবী মানুষ গোটা চৈত্র মাস জুড়ে মেতে ওঠেন এই বোলান বা বুলান গানে। পুরাণ মহাকাব্য থেকে সমকালের সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সবই বোলানের বিষয়বস্তু হলেও সাম্প্রতিক কালের বোলান গানে পুরাণ মহাকাব্যের থেকে সমকালীন বিষয় অনেক বেশি।
নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেবের কথায়, “বোলান শিল্পীরা জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকেই গান বাঁধেন। তারই প্রতিফলন ঘটেছে দুই ভিন্ন সময়ে বাঁধা গানে।” সিপিএমের নেতা এসএম সাদি বলেন, “বোলান শিল্পী সহ লোকশিল্পীরা কিন্তু বরাবরই আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। কখনও সরে যাননি। তবে আগে আমাদের বিরুদ্ধে গান বেঁধেছিলেন এমন কথা শুনিনি। তবে এখন যে গান গাইছেন তা গাওয়াই স্বাভাবিক।” তবে পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির জেলা আহ্বায়ক প্রশান্তকুমার দে’র দাবি, “বাম আমলে লোকশিল্পীরা খুবই দুরবস্থার মধ্যে ছিলেন। তৃণমূল সরকারের আমলে তাঁরা ভাল আছেন। তাই পরিবর্তনের গানই গাওয়া তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক। তবে এখন যে গান গাইছেন, সেটা সার্বিক চিত্র নয়, তা বিক্ষিপ্ত ঘটনা।”
পেশায় খেতমজুর প্রবীণ শিল্পী ফণিভূষণ ঘোষ বলেন, “কয়েকশো বছরের প্রচীন এই লোকগান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সময়োপযোগী করেছে। অথচ আমাদের মতো শিল্পীদের অবস্থার কোনও বদল ঘটেনি। তাই বছর দুয়েক আগে যখন রাজ্যজুড়ে বদলের হাওয়া, আমরাও তখন পরিবর্তনের স্বপ্নে মজে ছিলাম। ভেবেছিলাম নতুন সরকার আসবে। আমরা তো মাটির মানুষ। আমাদের ভাল হবে। কিন্তু না। দু’ বছর ঘুরতেই বুঝেছিও সব ভুল ভাবনা ছিল।”
তাই ৬২ বছরের নিমাই ঘোষ, ৫৫ বছরের প্রাণদা ঘোষ, ৭৪ বছরের সুনীল ঘোষের গলায় একই ভাবে স্বপ্নভঙ্গের কথা। কৃষ্ণগঞ্জের বাসিন্দা এবং বোলান গানের গবেষক বুদ্ধিশ্বর ঘোষ বলেন, “সমকালীন নানা বিষয়ে প্রতিবাদ বোলান গানের একশো বছরের ইতিহাসে বারবার ধরা পড়েছে। তবে সেই নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় থেকে নদিয়ার বোলান শিল্পীরা যে ভাবে বারে বারে জমি আন্দোলনের সমর্থনে গান বেঁধেছেন তা নজিরবিহীন। অথচ পরিবর্তনের পর নিম্নবিত্ত গ্রামীণ খেতমজুর বা প্রান্তিক চাষির জীবনে সামান্য পরিবর্তন আসেনি। বাম আমলে সিপিএমের সমালোচনা করে বোলান গায়কেরা কোনও সাহায্য পাননি। কোনও সরকারই কেউ তাদের ডাকেনি। আবার আজ যখন পরিবর্তনের পর নতুন সরকার এল, তখনও সামান্য লোকশিল্পীর পরিচয়পত্রটুকুও এদের জোটেনি।” |