মাজার শরিফে পাশাপাশি শুয়ে আছেন দুই ধর্মগুরু। একজন মুসলিম সম্প্রদায়ের বারাখান শহীদ। অপর জন হিন্দু সম্প্রদায়ের সত্যনারায়ণ গোস্বামী। আর তাঁদেরই সমাধি দেওয়ার দিনকে কেন্দ্র করে চৈত্রের শেষ শুক্রবার মিলন মেলায় মেতে ওঠে দুই ধর্মের মানুষজন।
বছরের পর বছর কাঁকসার সিলামপুরে হয়ে আসছে এই মিলন মেলা। দামোদর নদের পাশেই ওই গ্রামে চৈত্র মাসের শেষ শুক্রবার এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। কথিত আছে, প্রায় চারশো বছর আগে বারাখান সাহেব খাজাবাবার সঙ্গে ভারতে আসেন। তিনি সৈন্যদের সর্দার ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি আফনাগিস্তান থেকে এ দেশে আসেন ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে। এখানে এসে মিলিত হন হিন্দু ধর্মের সত্যনারায়ণ গোস্বামীর সঙ্গে। সত্যনারায়ণ কাঁকসার কঙ্কেশ্বর মন্দিরে থাকতেন। তাঁর কিছু অলৌকিক শক্তি ছিল বলেও শোনা যায়। নানা রকম জল, ফল দিয়ে তিনি এক বার বারাখান সাহেবের বেশ কিছু লোককে সুস্থ করে তুলেছিলেন বলে শোনা যায়। সেই থেকেই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। দু’জনেরই অগণিত ভক্ত ছিল। এরাই এক হয়ে সিলামপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। শোনা যায়, সত্যনারায়ণবাবুও ইসলামের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ‘ধর্মযুদ্ধে’ তাঁরা দু’জনেই শহীদ হন। চৈত্রের শেষ বৃহস্পতিবার তাঁরা শহীদ হন বলে দাবি এলাকার বাসিন্দা আলিদাদ খাদিম, সাহেবদাদ খাদিমদের। এর পরের দিন অর্থাত্ শুক্রবার তাঁদেরকে সমাধিস্থ করা হয়। আর তাই এই দিনটিতেই মেতে ওঠেন হিন্দু মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষই। |
বিভেদ ভুলে এক আসনেই খাওয়াদাওয়া। নিজস্ব চিত্র। |
শুধু সিলামপুর নয়, আশপাশের অনেক গ্রাম থেকে, এমন কি বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকে মানুষজন আসেন এই মিলন মেলায় যোগ দিতে। এলাকার বাসিন্দা আলিদাদ খাদিম জানান, শুক্রবার দুপুর ১২ টা থেকে এই মাজারে হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমান চাদর চাপাতে। এ বারও বাঁকুড়ার ডিহিপাড়া, রাঙামাটি, বাসুদেবপুর গ্রাম থেকে অনেকে এসেছেন। বাঁকুড়ার সোনামুখির মৈঠ্যা গ্রামের গৃহবধূ ভারতী মণ্ডল বলেন, “আমরা প্রতি বছরই পুজো দিতে এখানে আসি। কখনওই মনে হয় না, এটা অন্য সম্প্রদায়ের কিছু।” তিনি আরও জানান, এই মাজারকে তাঁরা অনেকেই আবার মন্দির বলেন। বারাখান সাহেব ও সত্যনারায়ণবাবুর ভক্তদের মধ্যে হিন্দুরাই বেশি। সিলামপুরে আর এক বাসিন্দা সাহেবদাদ খাদিম জানালেন, দিনে তিন বেলা এখানে পুজো হয়। সন্ধ্যায় এই মাজারের ডঙ্কা বাজানোর পর গ্রামের প্রতি বাড়িতে এখনও সন্ধ্যা দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। মাজারে বর্তমান পাঁচ জন সেবাইত। তাঁরাই নিত্য পুজো করেন। আলিদাদবাবু বলেন, “এখানে হিন্দু মতেও দুই গুরুর পুজো দেওয়া হয়।”
শুক্রবার দুপুরে মেলায় ভিড় জমিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। অনেকেই মাজারে দুই ধর্মগুরুর জন্য চাদর দিয়ে আসছেন। তারপর ছিল পঙ্ক্তি ভোজনের আসর। এক সঙ্গে পাত পেড়ে বসে খেলেন সবাই। পরিবেশনও করলেন। রানিগঞ্জ থেকে চাদর বিক্রি করতে এসেছিলেন গুল্লু খান, এমডি গুড্ডু। এছাড়াও ছিল রকমারি খাবারের দোকান থেকে আইসক্রিমের স্টল। বাঁকুড়ার চোখাই থেকে এসেছে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র শামসের আলি খান। তার কথায়, “মেলা দেখতে এসেছিলাম। পাঁপড় থেকে আইসক্রিম, সবই খাওয়া হয়ে গেল।” |