গরম এখনও সেভাবে জাঁকিয়ে পড়েনি। তবে তার আগেই নদিয়ার চাপড়ার কয়েকশো খালবিল শুকিয়ে যাওয়ায় সমস্যায় মৎস্যজীবীরা। কয়েক বছর আগেও এপ্রিল মাসে যে সব বিলে জল টলটল করত, সেখানে এখন জল শুকিয়ে যাওয়ায় মাছ চাষ করা যাচ্ছে না। উৎপাদন কমায় মৎস্যজীবীরা বাধ্য হয়ে দিনমজুরের কাজ করছেন।
জেলার অন্যতম মাছ উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত চাপড়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে ছোট বড় অনেক বিল ও জলাশয়। এদের মধ্যে রয়েছে ধর্মদহ বিল, পুঁটিয়া-ইছাপুর বিল, দক্ষিণ রাঙিয়ার পোতা বিল, কুকরাদহ বিল, হৃদয়পুরের জিধার বিল। এ ছাড়া আছে পলদর বিল, হালদির বিল, ঝাপপাড়া বিল। পলদার বিল থেকে আগে কৃষ্ণনগরের সিংহভাগ মাছের যোগান হত। এখন ও ই বিলের ৬০ শতাংশই শুকিয়ে গিয়েছে। বাগবেড়িয়াঘাট থেকে দুধগোলা আর মহেশপুর থেকে কাদাঘাট পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিমি অংশে খালের জল শুকিয়ে গিয়েছে। এ ছাড়াও আলফা শুকনির বিল, কলিঙ্গ বিল, ও বেতবেড়িয়ার বিলেরও একই অবস্থা।
এমন হওয়ার কারণ কী? মৎস্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এক সময় চাপড়ার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সরস্বতী নদী এখন খালে পরিণত হয়েছে। জলঙ্গী নদীর জল সরস্বতী খালের মাধ্যমে ওই সব বিলগুলিকে পুষ্ট রাখত। এখন সে পথ বন্ধ। |
আবার বাঙাল ঝির কাছে ন’মাইলে জলঙ্গী নদী থেকে একটি খাল বের হয়ে দুটি ভাগে পলদা বিলে মিশেছে। ইটভাটা সহ নানা কারণে ন’মাইলের কাছে ওই খালের উৎস মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জলঙ্গীর জল কোনওভাবেই ঢুকতে পারছে না। ফলে বর্ষা ছাড়া অন্য সময়ে মাছ চাষ দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
চাপড়া ব্লকের মৎস্য আধিকারিক সুশীল রায় বলেন, “বর্ষার তিন মাস ছাড়া কোনও বিলে জলের অভাবে মাছ চাষ করা যাচ্ছে না। ফলে বিশাল পরিমাণ মাছের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। দশ বছর আগেও যা মাছ চাষ হত, এখন তার মাত্র কুড়ি শতাংশ হয়।” ত্রিশ বছর ধরে মাছ চাষের সঙ্গে যুক্ত পদ্মমালা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির ম্যানেজার নিত্য হালদারের কথাতেও হতাশার সুর। তাঁর বক্তব্য, কয়েক বছর আগেও যে বিলগুলিতে চৈত্রে ছ’ফুট জল থাকত, সেখানে এখন একফোঁটাও জল নেই। বর্ষার তিন মাসে যে সামান্য মাছ চাষ হয় তা দিয়ে সংসার চলে না।
মাছ চাষ কমায় বাঙালির রোজকার খাবারের পাতের মাছেরও টান পড়েছে। নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে ল্যাটা, শোল, পুঁটি, ট্যাংরা, পাকাল, ফলুই, মৌরলা, বোয়ালের মতে দেশি মাছগুলি। নদিয়ার বিভিন্ন বিলের উপর দীর্ঘদিন কাজ করেছেন বারাসত সরকারি মহাবিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক দেবজ্যোতি চক্রবর্তী। তার মতে, “নদীর সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বিলগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে বিপন্ন হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যও।” তিনি আরও জানান, জলাশয়গুলি শুকিয়ে যাওয়ায় ৭৭টি প্রজাতির মাছ, ৩৫-৪০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, অন্যান্য প্রাণীরা বিলুপ্ত হতে বসেছে। মৎস্যদফতরের আধিকারিকরা জানান, দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়াই বিলগুলি শুকিয়ে যাওয়ার কারণ। তাছাড়া চাষের জমির সেচের কাদাগোলা জল বিলগুলিতে পড়ায় নাব্যতা কমছে। নদিয়ার অতিরিক্ত জেলা শাসক উৎপল ভদ্র বলেন, “একশো দিনের কাজের প্রকল্পে জলাশয়গুলি সংস্কারের ব্যপারে মৎস্য দফতরের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।” |