আইনকে বিদ্যালয়ের উচ্চ স্তরে বিষয় হিসাবে গ্রহণ করা যাইবে সেন্ট্রাল বোর্ডের পাঠ্যসূচিতে, এইরূপ একটি বিকল্প প্রদান করিবার কথা উঠিয়াছে। বিদ্যালয় স্তরে আইনের পাঠ লইয়া কী হইবে, এমন প্রশ্ন ওঠা সম্ভব। সর্বাগ্রে লক্ষণীয়, আইনের জ্ঞান ও আইনের দর্শনের সঙ্গে আইনের প্রয়োগের ফারাক রহিয়াছে। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞান যেমন সমার্থক শব্দ নহে, তেমনই আইন ও ওকালতি একার্থক নহে। প্রযুক্তিবিদ যিনি, তিনি বিজ্ঞানের জগতে মৌলিক কোনও আবিষ্কার বা ভাবনার নজির নাই রাখিতে পারেন। খুবই সফল আইনজ্ঞ আইনের দর্শন ও নীতি সম্বন্ধে সচেতন নাই হইতে পারেন। বিদ্যালয় স্তরে ছাত্রছাত্রীদের আইন পড়াইবার অর্থ ইহা নহে যে তাঁহারা সকলে ভবিষ্যতে ওকালতি করিবেন। আইনের অন্য একটি দিক বর্তমান। নৈর্ব্যক্তিক যুক্তিকে কেমন করিয়া প্রমাণ ও নিদর্শনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করিতে হয়, তাহা আইনের বিদ্যা শিক্ষা দেয়। বিদ্যালয় স্তরে আইন যথাযথ ভাবে পড়ানো হইলে ছাত্রছাত্রীরা যুক্তির এই দিকটি সম্বন্ধে অবহিত হইবেন। ভবিষ্যতে যাহাই পড়ুন না কেন, জীবনে অর্থ উপার্জনের যে পন্থাই অবলম্বন করুন না কেন, যুক্তি ও প্রমাণের এই দিকটি যদি ছাত্রজীবনে অনুশীলন করা যায়, তাহা হইলে বড়ই লাভ। ঊনবিংশ শতকে বহু চিন্তক আইন ব্যবসায়ী ছিলেন। আইনজ্ঞ হিসেবে তাঁহারা সবাই সমান সফল ও উপার্জনশীল ছিলেন না।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আদি যুগের চার পুরোধা পুরুষ মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র আইনকে এক অর্থে ব্যবসা হিসাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু পাশাপাশি, তাঁহাদের রচনা ও চিন্তার মধ্যে আইনের যুক্তি নানা ভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। বিশেষ করিয়া বঙ্কিম যখন বিষবৃক্ষ ও কৃষ্ণকান্তের উইল-এর ন্যায় উপন্যাস লিখিয়াছিলেন, তখন আইনজ্ঞ ডেপুটি বঙ্কিমের যুক্তি নরনারী সম্পর্কের হিতাহিতের প্রসঙ্গে যেন ক্রিয়াশীল। রামমোহনের সহমরণ রদ সংক্রান্ত রচনায় ও বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলন সংক্রান্ত বিতর্কে যুক্তি বিন্যাস যেন আইনের পথ মানিয়া চলিতেছে। চিন্তা আর যুক্তির নৈর্ব্যক্তিক কাঠামো গড়িয়া তুলিবার জন্যই আইন পাঠ করা যাইতে পারে। প্রতিপক্ষের মত ধৈর্য সহকারে শোনা এবং নিজ বক্তব্যকে যুক্তি দিয়া প্রতিষ্ঠার কৌশল চর্চা ভারতবর্ষের ন্যায় অতিনাটকীয় আবেগ ও অযুক্তির দেশে বড় প্রয়োজন। এ দেশে এখনও পরিস্থিতি বিচারের ঢের পূর্বে আমিত্বের তম্বিকে জায়গা দেওয়া হয়। ছাত্রজীবন ক্রমশ যাহা হারাইতেছে, সেই ধৈর্য, জিজ্ঞাসা, পাল্টা প্রশ্ন ফিরাইয়া আনা জরুরি। এই সময়েই চিন্তার গোড়ায় সার দিবার উপযুক্ত সময়। রাজনীতি হইতে শয়নকক্ষ সর্বত্রই নিজ মতকে অভ্রান্ত এবং অদ্বিতীয় বলিয়া মানা এবং অপরের সমস্ত যুক্তিকেই ‘বুরবকের যুক্তি’ বলিয়া খারিজ করিবার যে প্রবণতা দেখা যাইতেছে, সে চিত্র হয়তো কিছু বদলাইতে পারে। তবে সে জন্য আইনের জ্ঞানচর্চাকে আইনের ব্যবহারিক প্রয়োগ হইতে স্বতন্ত্র করিয়া দেখিতে হইবে। |